ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মাজরা পোকা ও পচা রোগে নষ্ট হচ্ছে ধানখেত

মাজরা পোকা ও পচা রোগে নষ্ট হচ্ছে ধানখেত

কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার বিস্তীর্ণ ধানখেতে সম্প্রতি ব্যাপকহারে মাজরা পোকা, পচা রোগ ও ইদুরের আক্রমণ দেখা দিয়েছে। এইসব প্রাদুর্ভাবের কারণে কৃষকরা তাদের সোনালি ফসলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উদ্বেগে রয়েছেন। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে এবং সেইসঙ্গে ধানের পচা রোগ বা ব্লাস্ট রোগের আক্রমণও অনেক জমিতে দৃশ্যমান। এর ফলে চলতি আমন মৌসুমে ফলন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।

চান্দিনার কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে পৌষ ধান একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে এবার বাম্পার ফলনের স্বপ্ন দেখছিলেন কৃষকরা, কিন্তু মাজরা পোকা ও পচা রোগের হানা সেই স্বপ্নে বাধা সৃষ্টি করেছে। মাজরা পোকা ধানের শীষের গোড়ায় আক্রমণ করে, যার ফলে ধানের গাছ শুকিয়ে যায় এবং শীষের মধ্যে চাল সৃষ্টি হয় না। স্থানীয়ভাবে এই ক্ষতিকে ‘সাদা শীষ’ বা ‘মড়ক লাগা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। একবার আক্রমণ শুরু হলে এর বিস্তার দ্রুত হয়, যা অল্প সময়ের মধ্যেই বিশাল এলাকাকে গ্রাস করে ফেলতে পারে।

অন্যদিকে, ধানের ব্লাস্ট রোগ একটি ছত্রাকজনিত সমস্যা, যা মূলত আবহাওয়ার তারতম্য, বিশেষ করে দিনে গরম ও রাতে ঠান্ডা এবং অতিরিক্ত আর্দ্রতার কারণে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগ পাতার উপর প্রথমে ছোট ছোট চোখের মতো দাগ তৈরি করে এবং পরে তা পাতার সংযোগস্থল বা গিট (Node) এবং ধানের শীষকেও আক্রমণ করে। শীষে আক্রমণ করলে ধানের দানা চিটা হয়ে যায় বা অপরিণত অবস্থায় ঝরে পড়ে। কৃষকরা বলছেন, একইসঙ্গে মাজরা পোকা ও ব্লাস্ট রোগের দ্বিমুখী আক্রমণে তাদের ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক মেহার গ্রামের মজলু মিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা নিয়মিত কীটনাশক ব্যবহার করার পরেও এই পোকা ও রোগের সংক্রমণ থামাতে পারছেন না। একই কথা বলেন গ্রামের কৃষক মো. শফিউল্লাহ। তারা জানান পোকা দমন ও পচা রোগ থেকে রক্ষার জন্য কত রকম কীটনাশক স্প্রে করছি কিন্তু কোনোভাবেই রক্ষা করতে পারছি না। অনেক কৃষকই সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় এবং সঠিক ধরনের কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক প্রয়োগের বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছেন না। কেউ কেউ বলছেন, বাজারে নিম্নমানের কীটনাশক সরবরাহ হওয়ায় তা প্রত্যাশিত ফল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

এছাড়া, ঘন বৃষ্টিপাত ও মেঘলা আবহাওয়ার কারণে স্প্রে করা কীটনাশক দ্রুত ধুয়ে যাচ্ছে, যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে। কৃষকদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে, কারণ ফসলের ফলন কম হলে তাদের পারিবারিক চাহিদা মেটানো এবং কৃষি ঋণ পরিশোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

এই সংকটময় মুহূর্তে চান্দিনা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এরইমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন এবং কৃষকদের সঠিক পরিচর্যা পদ্ধতি এবং কার্যকরী বালাইনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন। মাজরা পোকার ক্ষেত্রে আলোক ফাঁদ (খরমযঃ ঞৎধঢ়) ব্যবহারের মাধ্যমে পোকা দমন করার কৌশল এবং পচা রোগের জন্য অনুমোদিত ছত্রাকনাশক স্প্রে করার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। তবে দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের পোকা ও রোগ আক্রমণের ঝুঁকি কমাতে হলে কৃষকদের উচিত, রোগ প্রতিরোধী জাতের ধান চাষ করা এবং ফসলের শুরু থেকেই সঠিক মাত্রায় সার ব্যবহার করা। অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার ব্যবহার করলে ধানের গাছ নরম হয়ে যায়, যা মাজরা পোকা ও ব্লাস্ট রোগ উভয়ের আক্রমণকেই ত্বরান্বিত করে। তাই সার প্রয়োগে সুষমতা বজায় রাখা খুব জরুরি। এছাড়া, জমির সঠিক জল ব্যবস্থাপনা এবং আক্রান্ত গাছগুলো দ্রুত সরিয়ে ফেলাও সংক্রমণ রোধে সহায়ক হতে পারে।

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায়, চান্দিনার ধানখেত রক্ষার জন্য এখন জরুরিভিত্তিতে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। কৃষি বিভাগ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং কীটনাশক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত কৃষকদের সঠিক তথ্য, উন্নতমানের কৃষি উপকরণ এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দিয়ে এই বিপর্যয় মোকাবিলায় সাহায্য করা। অন্যথায়, মাজরা পোকা ও পচা রোগের কারণে চান্দিনার আমন ধান চাষে যে বিশাল ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তা পূরণ করা কঠিন হবে। কৃষকদের জীবন-জীবিকা সুরক্ষার জন্য এখনই সম্মিলিত প্রচেষ্টা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত