
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে তিনদিনের টানা বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া দেশের বিভিন্ন স্থানে আমন ধানগাছ নুয়ে পড়েছে। পাশাপাশি শাকসবজি খেতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে কৃষিখাতে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নকলা (শেরপুর) : শেরপুরের নকলায় গত শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে কৃষি আবাদি মাঠ। বৃষ্টির পাশাপাশি ঝড়ো হাওয়ায় আমন আবাদসহ শীতকালীন শাক সবজির ব্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ফলে আমন ধান কাটার আগেই ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষক। এছাড়া জমির জোঁ নষ্ট হওয়ায় পিছিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে শীতকালীন আগাম শাক সবজির আবাদ। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ঝড়ো হাওয়ায় পানিতে পড়ে গেছে ধানের ভিতর চাল হয়ে যাওয়া জমির ধান গাছ। তাছাড়া শীতকালীন শাক সবজির খেত ও শাকসবজির বীজ বপণের জন্য তৈরি করা জমিতে পানি জমে জমির জোঁ নষ্ট হয়ে গেছে। উপজেলার প্রায় সব কয়টা ইউনিয়নের নিচু এলাকার কৃষিজমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি জন জীবনে নেমে এসেছে দুর্ভোগ; হতাশায় পড়েছেন উপজেলার হাজারো কৃষিজীবী পরিবার।
শীতকালীন শাকসবজি চাষে ও উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন কৃষক। তারা জানান, উপজেলায় শাতধিক ফলজ বৃক্ষ উপড়ে পড়ে গেছে। রাস্তার ধারে অনেক পুকুর পাড়ে রোপণ করা কলা গাছ ও বিভিন্ন ফলজ গাছ উপড়ে পড়ে যাওয়ায় কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
তথ্য মতে, উপজেলায় আবাদযোগ্য জমি আছে ১৪ হাজার ৯৭০ হেক্টর। তবে নিট ফসলি জমি রয়েছে ১৪ হাজার ৮১০ হেক্টর।
এরমধ্যে উঁচু জমি আছে ৫ হাজার ১৪০ হেক্টর, মাঝারি উঁচু জমি ৪ হাজার ৬৯৩ হেক্টর, মাঝারি নিচু জমি ৩ হাজার ৮৪০ হেক্টর, নিচু জমি ৮১৫ হেক্টর ও অতি নিচু জমি আছে ৩৮২ হেক্টর। এসব মাঝারি উঁচু, মাঝারি নিচু, নিচু ও অতি নিচু জমিতে চাষ করা আমন আবাদের প্রায় সব এলাকার ধান গাছ কমবেশি পানিতে পড়ে গেছে এবং অনেক নিচু ও অতি নিচু খেত পানিতে ডুবে গেছে। কৃষকরা জানান, অন্য যেকোনো আবাদের তুলনায় শীতকালীন আগাম শাকসবজি চাষে বেশি লাভ পাওয়া যায়।
তাই তারা শীতকালীন আগাম শাকসবজি চাষ করেছিলেন। এছাড়া কেউ কেউ শাকসবজি চাষের জন্য জমি তৈরি করছিলেন। হঠাৎ বৃষ্টিতে কৃষকের সব স্বপ্ন যেন পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিম মেহেদী জানান, চলমান বৃষ্টিতে কৃষকের কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, কি পরিমাণ জমির ধান গাছ পানিতে পড়ে গেছে ও কি পরিমাণ ধান পানিতে তলিয়ে গেছে তা এখনও সঠিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে, কয়েক দিন বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে কৃষকের অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু আজ কালের মধ্যে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেলে কৃষকের তেমন ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। আর যেসব আমন ধানের খেতে পটাশ ও জৈব সার কম প্রয়োগ করা হয়, সে সব জমির ধান গাছ অপেক্ষাকৃত কম শক্ত থাকে বিধায় সামান্য বাতাস হলেই পড়ে যায়। তাই নিয়মিত কৃষি বিভাগ থেকে পরিমিত পরিমাণে জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়। তার পরেও অনেক কৃষক তাদের পরামর্শকে আমলে না করে মনগড়াভাবে সার প্রয়োগ করেন বলেই এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন তারা। তাছাড়া অনেক কৃষক উঁচু জাতের ধান রোপণ করাতেও বাতাসে অনেক সময় ধান গাছ পড়ে যায়। তবে বর্তমানের বৃষ্টিতে যে পরিমাণ ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে, তাতে উপজেলায় আমন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কোনো প্রভাব পরবে না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আরও জানান, যেসব জমি শীতকালীন শাকসবজি রোপণের জন্য তৈরি করা হয়েছিল, বৃষ্টিতে আপাতত সেসব জমির জোঁ নষ্ট হলেও, বৃষ্টি থেমে গেলে অতি তাড়াতাড়ি জমির জোঁ এসে যাবে। আর যেসব জমিতে শাক সবজি গজিয়ে গেছে, সে সব জমির জন্য এই বৃষ্টি ক্ষতি করবে না, বরং ওই ফসলের উপকার হবে বলে আশা ব্যক্ত করেন কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিম মেহেদী। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে ছুটির দিনেও মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকের মাঠে গিয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন বলে তিনি জানান।
চিরিরবন্দর (দিনাজপুর) : দিনাজপুর চিরিরবন্দর উপজেলায় টানা তিনদিনের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও হালকা বাতাসে কৃষকের চিকন জাতের সুগন্ধি ধান মাটিতে নুয়ে পড়েছে। এতে ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা করছে কৃষকরা। চিরিরবন্দর উপজেলা সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, টানা তিনদিনের বৃষ্টি ও বাতাসের কারণে প্রায় ৬০০ হেক্টর জমির ধান মাটিতে পড়ে গেছে। কৃষি অফিস থেকে মাঠ পার্যায়ে কৃষদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। আন্ধারমুহা গ্রামের কৃষক শরিফুল ইসলাম বলেন, বৃষ্টি আর বাতাসের কারণে আমার তিন বিঘা চিকন জাতের সুগন্ধি ধানের মধ্যে প্রায় দুই বিঘা জমির ধান মাটিতে পড়ে গেছে। ধান সুন্দরভাবে বের হয়েছিল ভেবেছিলাম এবার ফলন ভালো হবে কিন্তু ধান পরিপূর্ণ হবার আগে মাটিতে পড়ে গেছে এখন উৎপাদন খরচ উঠবে কি না সে চিন্তা করছি।
পলাশবাড়ী গ্রামের কৃষক সোহেল রানা বলেন, চিকন জাতের ব্রি-৩৪ জাতের ধানগুলো কেবল বের হয়েছে এখন দানা আসেনি তার আগে আকাশে বৃষ্টি আর বাতাসে প্রায় ৪ বিঘা জমির ধান মাটিতে পড়ে গেছে। দ্রুত রোদ উঠলে হয়তো কিছুটা উপকার হবে ধানগুলোর। কিন্তু আজও আকাশ মেঘলা যে কোনো সময় বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। এভাবে আকাশে বৃষ্টি বাতাস হলে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা নাই।
একই কলাকার কৃষক এরশাদ আলী বলেন, আর এক সপ্তাহ পরে ধানগুলো কাটব ভাবছি কিন্তু বৃষ্টিতে সব ধান মাটিতে পরে পানির নিচে তলিয়ে গেছে। দ্রুত বৃষ্টি শেষ রোদ উঠলে ধানগুলো কাটতে পারব। পড়ে যাওয়া ধান কাটতে শ্রমিকদের বেশি মজুরি দিতে হবে বেশি মজুরি না দিলে ধান কাটবে না শ্রমিকরা। এমনিতে ধানে পোকা আর ইঁদুরের আক্রমণে ফলন আশানুরূপ হবে না তার উপর ধান পড়ে যাওয়া উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উপজেলার সাইতাঁড়া ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মেনহাজুল ইসলাম নবাব বলেন, আমরা সকাল থেকে মাঠে উপস্থিত থেকে কৃষকদের নানা ধরনের পরামর্শ দিচ্ছি বৃষ্টির আর বাতাসে কারণে সাইতাঁড়া ইউনিয়ন প্রায় ৫০ হেক্টর জমির ধান মাটিতে নুয়ে পড়েছে।
চিরিরবন্দর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা জোহরা সুলতানা বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোন্থার প্রভাবে চিরিরবন্দর প্রায় ৬০০ হেক্টর চিকন জাতের সুগন্ধি ধান বি-৩৪ ও মোটা জাতের বিভিন্ন ধান মাটিতে পড়ে গেছে। আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি ব্রি-৩৪ চিকন জাতের সুগন্ধি ধান যেভাবে পড়ে আছে সেভাবেই রাখতে হবে। রোদ পেলে কিছু ধান এমনিতে মাটি থেকে দাড় হবে। আর মোটা জাতের যে ধানগুলো পাকা ধরছে সেগুলো কয়েকদিনের মধ্যে কাটবে সেগুলোতে তেমন সমস্যা হওয়ার কথা না। কিছু মোটা জাতের ধান পড়ে গেছে এখনও পাকতে ২ সপ্তাহের বেশি সময় লাগবে সেগুলো ধান গাছ একসঙ্গে করে বাঁধে দাড় করিয়ে দিতে হবে।
রাণীশংকৈল (ঠাকুরগাঁও) : বৈরী আবহাওয়ায় মাঝারি ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে দমকা বাতাসের কারণে, ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার প্রায় কয়েক শতাধিক কৃষকের আমন ধান ও আলুসহ বিভিন্ন সবজির খেত নিয়ে চরম দুঃশ্চিন্তায় দিন পার করছেন এ কৃষকরা। রাতদিন ঝিমঝিম বৃষ্টি আর আচমকা দমকা বাতাসের কারণে আমন ধানের গাছ মাটিতে নুয়ে পড়েছে এবং যেসব আগাম জাতের হাইব্রিড ধান কেটে শুকাতে দেওয়া হয়েছে সেগুলো প্রায় জমিতেই পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
এরসঙ্গে আগাম ধান কাটার পর যে সব কৃষক আলুর বীজ বপন করেছেন, তারাও দুঃশ্চিনতায় দিন পার করছেন। উপজেলা প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নের একই অবস্থা। নন্দুয়ার ইউনিয়নের কৃষক রিয়াজুদ্দিন বলেন, ধান কেটে জমিতে রেখে ছিলাম শুকাতে মাত্র একটা দিন সময় পেলেই সব ধান মারাই করে ঘরে তুলতে পারতাম এখন সব ধান পানিতে তলিয়ে গেছে কি হবে এগুলো এখন ভাবতে পারছি না। একই ইউনিয়নের কৃষক আজিজুর, মুনসুর আলী জানান প্রায় দুই বিঘা জমিতে আমন ধান রোপণ করেছি কিন্তু হঠাৎ করে বিরূপ আবহাওয়া কারণে, ধানের গাছগুলো মাটিতে নুয়ে পড়েছে, এখন ধানগুলো বের হওয়ার সময় হয়েছে আর কয়েকদিন গেলে ধান পাকা হতো একই তো কারেন্ট পোকার আক্রমণ, এবার মনে হচ্ছে লাভের চেয়ে লোকসানের মুখ গুণতে হবে বেশি।
কাশিপুর ইউনিয়নের কুদ্দুস, এরশাদ ও আব্দুর রশিদ জানায়, হঠাৎ করে ৫ দিনের বৈরী আবহাওয়ার কারণে এবার আগাম আলু ও ধান যারা করেছেন তাদের প্রচুর লোকশানের মুখে পড়তে হবে। রাণীশংকৈল কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ১৬৫ হেক্টর জমির আগাম জাতের হাইব্রিড ধান পানি ও বাতাসের কারণে হেলে পড়েছে ও কর্তন করা ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। রাণীশংকৈল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সহিদুল ইসলাম জানান, আমরা এখনও পর্যন্ত কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটা বলতে পারছি না তবে আমাদের ক্ষতির পরিমাণ জানার জন্য কাজ চলমান রয়েছে। ফসলের ক্ষতি হওয়া কৃষকদের তালিকা করে কৃষি প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসা হবে।