ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

উন্নত জাতের মুরগি পালনে তরুণ উদ্যোক্তা স্বাবলম্বী

সাত হাজার টাকার পুঁজি চার বছরে সাত লাখ
উন্নত জাতের মুরগি পালনে তরুণ উদ্যোক্তা স্বাবলম্বী

পুঁজি মাত্র সাত হাজার টাকা। অথচ সেই সামান্য বিনিয়োগই আজ ডানা মেলেছে তিন লাখ টাকার বিশাল উদ্যোগে। কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার কুটুম্বপুর গ্রামের মো. শাকিল। তিনি বিদেশি উন্নত জাতের মুরগি পালনে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের কাছে এক অনুপ্রেরণার নাম। শাকিল ২০২১ সালে ইন্টারমিডিয়েট পড়া অবস্থায় শখের বসে তিনি গড়ে তুলেছিলেন শাকিল অ্যাগ্রো ফার্ম। এটি একটি বিদেশি মুরগির ফার্ম। চিরায়ত কৃষির বাইরে গিয়ে ব্যতিক্রমী কিছু করার নেশা থেকেই শাকিল আজ সফল এক পোল্ট্রি ফার্মার, যার হাতে গড়া ফার্মে শোভা পাচ্ছে বিশ্বের ১২টি উন্নত দেশের দুর্লভ প্রজাতির মুরগি।

২০২১ সালে যখন বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা চলছিল, ঠিক তখনই পিতা আলী আহমদণ্ডএর সন্তান শাকিল এই চ্যালেঞ্জিং পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নেন। ছোট আকারের একটি শেড এবং হাতে গোনা কয়েকটি বিদেশি মুরগি নিয়ে শুরু হয় তার যাত্রা। শুরুতে স্থানীয় জাতের বাইরে গিয়ে এই ভিন্ন পথে বিনিয়োগ নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করলেও শাকিলের আত্মবিশ্বাস ছিল দৃঢ়। দেশীয় বাজারে বিদেশি মুরগির চাহিদা এবং উচ্চমূল্যের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন তিনি। বর্তমানে তার বাড়ির ফার্মটি যেন বিভিন্ন দেশের মুরগির এক মিলনমেলা। এই ফার্মে রয়েছে অস্ট্রালর্প (অস্ট্রেলিয়া), ব্রাহমা (ভারত-আমেরিকা), সিল্কি (চীন), ফিজ্যান্ট (ইউরোপ) সহ বিশ্বের ১২টি ভিন্ন দেশের আকর্ষণীয় ও মূল্যবান প্রজাতির মুরগি। কেবল শখের বশে নয়, বাণিজ্যিকভিত্তিতে এই মুরগিগুলো পালন করছেন তিনি। প্রতিটি প্রজাতির মুরগির জন্য আলাদা পরিচর্যা, খাদ্য এবং স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে শাকিল তার ফার্মকে রেখেছেন রোগমুক্ত ও উৎপাদনশীল।

শাকিলের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হলো আধুনিক প্রযুক্তি ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার। তিনি স্থানীয় বাজারের ওপর নির্ভর না করে সরাসরি অনলাইনে দেশের বিভিন্ন স্থানে তার ফার্মের মুরগি বিক্রি করেন। তার বিক্রয় কৌশল এবং উন্নত জাতের কারণে প্রতিটি মুরগি ১৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০০ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়। এই উচ্চমূল্য তার তিন লাখ টাকার পুঁজি এবং লাভের অঙ্ককে দ্রুত বাড়িয়ে দিচ্ছে। গুণগত মান ও সঠিক ডেলিভারির কারণে অল্প সময়েই তিনি অনলাইন ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করেছেন।

গত ২৬ নভেম্বর ২০২৫, চান্দিনা প্রাণিসম্পদ মেলায় শাকিলের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ আরও বেশি মানুষের নজরে আসে। মেলায় তিনি তার ফার্মের কয়েকটি ভিন্ন দেশের মুরগি প্রদর্শন করেন। দর্শনার্থীরা আগ্রহ নিয়ে মুরগিগুলোর গঠন, রঙ ও বৈশিষ্ট্য দেখেন। মেলায় উপস্থিত ছিলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। শাকিলের উদ্যোগ দেখে তারা অভিভূত হন এবং তাকে উষ্ণ সাহস যোগান। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক এই স্বীকৃতি শাকিলকে তার কাজে আরও বেশি মনোযোগী হতে এবং ফার্মের পরিধি বাড়াতে উৎসাহিত করেছে। কর্মকর্তারা তাকে আধুনিক পালন পদ্ধতি এবং সরকারি সহায়তার বিভিন্ন দিক নিয়েও পরামর্শ দেন। শাকিলের মতে, এই ধরনের মুরগি পালনে প্রাথমিকভাবে পুঁজি কিছুটা বেশি লাগলেও, এর বাজারদর অত্যন্ত ভালো এবং প্রতিযোগিতা তুলনামূলকভাবে কম। তিনি বলেন, ‘সঠিক পরিচর্যা ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে এই মুরগিগুলো দ্রুত বাড়ে এবং এদের ডিমের উৎপাদনও যথেষ্ট ভালো। আমি দেশের বেকার যুবকদের আহ্বান জানাই, চিরাচরিত পদ্ধতির বাইরে এসে এই ধরনের উচ্চমূল্যের পোল্ট্রি ফার্মিংয়ে হাত দিন।

শাকিলের এই উদ্যোগ শুধু তার ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দেয়নি, বরং গ্রামীণ অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য এনে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। সাত হাজার টাকা থেকে শুরু করে তিন লাখ টাকার সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা চান্দিনার শাকিল আজ লাখপতি হওয়ার পথে শুধু নিজেই এগোননি। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, একটু ভিন্ন চিন্তাভাবনা ও কঠোর পরিশ্রম থাকলে গ্রামে বসেও আন্তর্জাতিক মানের ব্যবসা করা সম্ভব। তার এই বিদেশি মুরগি পালন প্রকল্প বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে বলে মনে করছেন স্থানীয় কৃষি ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞরা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত