ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

টাঙ্গাইলে বিএনপির গলার কাঁটা বিদ্রোহী প্রার্থী

টাঙ্গাইলে বিএনপির গলার কাঁটা বিদ্রোহী প্রার্থী

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইলে আটটি সংসদীয় আসনের মধ্যে চারটিতে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী প্রচারণা চালাচ্ছে। অনেকেই স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছে। দুইটি আসনে জেলার সিদ্দিকী পরিবারের দুই ভাই বিএনপি প্রার্থীর মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া বিএনপি ঘোষিত সাতটি আসনের প্রার্থী ও তাদের কর্মীদের দখল-দাপট নিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ফলে জেলার আটটি আসনে বিএনপি প্রার্থীর বিজয় নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।

জানা গেছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলার আটটি সংসদীয় আসনের মধ্যে বিএনপি সাতটি, জামায়াত আটটি, ইসলামী আন্দোলন আটটি, খেলাফত মজলিস আটটি, গণঅধিকার পরিষদ তিনটি এবং গণসংহতি আন্দোলন দুইটি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আটটি আসনেই প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কোনো আসনেই জাতীয় পার্টির তৎপরতা নেই। এছাড়া টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেনি। এ আসনে প্রার্থী বাছাইয়ে তৃণমূলের পছন্দকে মূল্যায়ন না করা হলে বিএনপির ভরাডুবির আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম দলের প্রার্থী হিসেবে টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) এবং তার বড় ভাই মহান মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের কমান্ডার ইন চিফ আবদুল লতিফ সিদ্দিকী টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন।

সরেজমিনে জানা যায়, টাঙ্গাইলের আটটি সংসদীয় আসনের মধ্যে টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসন ব্যতিত সাতটিতে বিএনপির প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) আসনে ফকির মাহবুব আনাম স্বপনকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ায় একাধিক প্রার্থীকে তার বিরোধিতা করতে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ আলী এবং অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট কর্নেল আসাদুল ইসলাম ওরফে আজাদ। ফকির মাহবুব আনামের মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে উভয় প্রার্থী নির্বাচনি এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। মনোনয়ন পরিবর্তন না হলে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট কর্নেল আসাদুল ইসলাম ওরফে আজাদ বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে এরইমধ্যে দল থেকে তাকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিএনপি। দলীয় প্রার্থী ফকির মাহবুব আনাম স্বপনের বিরোধিতা করে মিছিল-সমাবেশ করায় গত বুধবার বিকালে মনোনয়ন বঞ্চিত বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলীর সমর্থিত মিছিলটি বাস স্ট্যান্ডের কাছাকাছি পৌঁছালে তাতে ককটেল নিক্ষেপ হয়। এতে পরিস্থিতি ব্যাপক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মোহাম্মদ আলীর সমর্থকরা প্রতিপক্ষকে ধাওয়া দিলে কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে বাস স্ট্যান্ডের সড়ক মোহনার তিন রোডে কয়েক কিমি ব্যাপী যানজট হয়। কয়েকটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর চালানো হয়। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ২৪ জন আহত হয়।

১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এ আসনে বিএনপি বিজয়ের মুখ দেখেনি (১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্যতিত)। এবার এ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ফকির মাহবুব আনাম স্বপন। তিনি ২০০১ ও ২০০৮ সালে এ আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে পরাজিত হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচন করেন মধুপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম সরকার (সরকার শহীদ)। তিনি কয়েক বছর আগে মারা গেছেন।

টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনে এবার বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এসএম ওবায়দুল হক নাসিরকে। কিন্তু বিষয়টি সহজভাবে নেয়নি এ আসন থেকে এর আগে একাধিক বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য সাবেক মন্ত্রী লুৎফর রহমান খান আজাদ ও তার অনুসারীরা। বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা লুৎফর রহমান খান আজাদ ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। দুই দফায় প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৮ ও ২০১৮ সালেও তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন।

এবারের মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে লুৎফর রহমান খান আজাদ ও অন্য মনোনয়ন প্রত্যাশী বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মাইনুল ইসলাম একাট্টা হয়ে মাঠে নেমেছেন। এসএম ওবায়দুল হক নাসিরের মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে তারা বিক্ষোভণ্ডসমাবেশ, ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। মনোনয়ন প্রত্যাশী মাইনুল ইসলাম জানান, এসএম ওবায়দুল হক নাসির এ এলাকার সন্তান নন। তাই তাকে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মী-সমর্থকরা মেনে নেবে না।

তারা আশা করেন দল এখানে মনোনয়ন পরিবর্তন করবে। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এসএম ওবায়দুল হক নাসির জানান, ঘাটাইল উপজেলার বিএনপি নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে তার প্রচারণায় অংশ নিচ্ছে। তারা নিজেদের কিছু অনুসারী নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।

টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য লুৎফর রহমান মতিন। তিনি ২০০৮ সালে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে এ আসনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি আসনটি তাদের জোটের শরিকদল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগকে ছেড়ে দেয়। এবার এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন দলের ঢাকা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক বেনজীর আহমেদ টিটো। কালিহাতী উপজেলা বিএনপি এবং কালিহাতী ও এলেঙ্গা পৌর বিএনপিসহ প্রতিটি ইউনিয়ন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর কমিটি তিনি গঠন করেছেন। ফলে কমিটির নেতাদের সমর্থন বেনজিরের দিকে রয়েছে। তিনি মনোনয়ন না পেলেও মাঠ ছাড়েননি। তিনি ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে সভা-সমাবেশ করছেন।

এ আসনে সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয় পর্যায়ে। বিএনপির প্রার্থীকে তাকেই মোকাবিলা করতে হবে। লতিফ সিদ্দিকী এ আসন থেকে এবারও স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন বলে তার ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে পাঁচবার এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে একবার (২০২৪) নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগে না থাকলেও দলের কর্মী-সমর্থকদের ওপর তার প্রভাব রয়েছে।

কালিহাতী উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক ও এলেঙ্গা পৌরসভার মেয়র মো. শাফী খান জানান, দল লুৎফর রহমান মতিনকে মনোনয়ন দিয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। দলীয় মনোনয়ন দিতে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে না পারলে কালিহাতী উপজেলা বিএনপি-৪ অংশে বিভক্ত হয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে পারতো। বিজ্ঞ রাজনীতিক লুৎফর রহমান মতিন দলীয় মনোনয়ন পাওয়ায় উপজেলার সিনিয়র-জুনিয়র নেতাকর্মীরা নির্বাচনি মাঠে নেমে পড়েছেন। তারা স্ব স্ব উদ্যোগে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। ঢাকা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক বেনজির আহমেদ টিটো তার কিছু আজ্ঞাবহ লোক নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে। উপজেলা বিএনপির পদধারী কয়েক নেতা নাম প্রকাশ না করে জানান, লুৎফর রহমান মতিন দলীয় পাওয়ায় কালিহাতী উপজেলা বিএনপির আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। বিষয়টি বিএনপির হাই কমান্ড বিবেচনায় নিয়ে তারা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বেনজির আহমেদ টিটোকে মনোনয়ন দেবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেন।

টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে বিএনপি এখনও প্রার্থী ঘোষণা করেনি। এখানে দলের অর্ধডজন নেতা মনোনয়নের জন্য মাঠে থাকলেও বেশি সক্রিয় রয়েছেন কেন্দ্রীয় বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু এবং জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল। তারা অনুসারী নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রতিদিন সভা, সমাবেশ ও গণসংযোগ করছেন।

টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) আসনে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আযম খানকে। এখানে অন্য দুই মনোনয়ন প্রত্যাশী সখীপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি শেখ হাবিবুর রহমান এবং শিল্পপতি সালাউদ্দিন রাসেল এক হয়ে সভা-সমাবেশ করে মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবি জানাচ্ছেন। এরই মধ্যে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক মন্ডলকে হুমকি দেওয়ার অডিও সমাজ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় জেলায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে আহমেদ আযম খান ফ্যাসিস্টের দোসরদের সামনে এনে স্থানীয় বিএনপি

নেতাদের অবমূল্যায়ন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে সখীপুর উপজেলা বিএনপিতে পদত্যাগের হিড়িক পড়েছে। সম্প্রতি পদত্যাগকারী উল্লেখযোগ্য নেতারা হচ্ছেন- সখীপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান সাজু, সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বাছেদ মাস্টার, সহ-সভাপতি আব্দুল মান্নান, গজারিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুর রউফ, ৮নং বহুরিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল লতিফ মিয়া প্রমুখ।

দলীয় মনোনয়ন না পেয়েও প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন, শিল্পপতি সালাউদ্দিন রাসেল। তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষ চায় আমি নির্বাচন করি। ওনাদের ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা।’ এরপর থেকে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। এদিকে, এ আসন থেকে নির্বাচন করবেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম। তিনি ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিএনপির প্রার্থীকে একদিকে নিজ দলের ‘বিদ্রোহী’ এবং অন্যদিকে কাদের সিদ্দিকীর মতো হেভিওয়েট প্রার্থীকে মোকাবিলা করতে হবে। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সখীপুর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সানোয়ার হোসেন জানান, তারা কাদের সিদ্দিকীর জন্য নির্বাচনি মাঠে কাজ করছেন। তাদের নেতা নির্বাচনে অংশ নেবেন।

টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সভাপতি হাসানুজ্জামিল শাহীন জানান, জেলার ১২টি উপজেলায় আটটি সংসদীয় আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় বিএনপি নানা বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনেও তৃণমূলের পছন্দসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করবে। এছাড়া জেলার রজনীতিতে ‘কাদের সিদ্দিকী ও লতিফ সিদ্দিকী’ অবশ্যই বিচক্ষণ ও বিজ্ঞ। কিন্তু আমাদের প্রার্থী ও আমরাও কম যাই না। ভোটের মাঠে তাদেরকে আমরা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত