
ছোট্ট একটা নদী ছিল, উজান ভাটির ঢেউয়ের টানে আজকের দিনে সেই গান ও নেই, নদী ও হারিয়ে গেছে কালের বিবর্তনে। সেই নদী হল কালা ডুমুর নদী। যার অবস্থান কুমিল্লা দাউদকান্দি ও চান্দিনা সীমান্তজুড়ে। কুমিল্লার কালা ডুমুর নদী মূলত গোমতী নদীর একটি শাখানদী, যা দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর এলাকা থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। সে নদী আজ মানব সভ্যতার পাশাপাশি বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ছে।
যেই নদীতে এক সময় বর্ষা আসলে মালবোঝাই নৌকা, ইঞ্জিনচালিত বড় বোট এবং কার্গো চলাচল করতো। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নদীর অস্তিত্ব আজ বিলুপ্তি পথে। কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার এ নদীর উৎসমুখ। গোমতী নদীর গৌরীপুর এলাকা। এটিকে গোমতীর শাখানদীও বলা হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে খনন না হওয়ায় নদীটির পেট এখন পলি, আবর্জনা আর কচুরিপানায় ভরাট হয়ে আছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে কুমিল্লা ও চাঁদপুর জেলার অন্তত চার উপজেলার হাজারো কৃষকের চাষাবাদ। নদীর গৌরীপুর থেকে ইলিয়টগঞ্জ ব্রিজ পর্যন্ত সরকারি ব্যবস্থাপনায় খনন করা হলে হাসি ফুটবে কৃষকের মুখে।
কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে মুরাদনগর ও চান্দিনার সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত একসময়ের খরস্রোতা কালা ডুমুর নদী আজ কেবলই মরা খালের প্রতিচ্ছবি। একসময় যে নদীর বুকে পাল তোলা সারি সারি নৌকা চলত, কৃষি জমিতে সেচ দিত প্রাণভরে, সেই নদী এখন ময়লা-আবর্জনা, অবৈধ দখল আর নির্বিচার ভরাটের শিকার হয়ে ধুঁকছে বিলীন হওয়ার পথে। প্রকৃতির এই অভিশাপের নেপথ্যে রয়েছে মানুষের অপরিণামদর্শীতা আর প্রশাসনের উদাসীনতা।
নদীটির এই করুণ দশার প্রধান কারণ হলো অবৈধ দখলদারিত্ব।
স্থানীয় প্রভাবশালী মহল দীর্ঘদিন ধরে নদীর পাড় ও তলদেশ ভরাট করে গড়ে তুলছে বসতভিটা, দোকানপাট এমনকি বহুতল বাণিজ্যিক স্থাপনা। বিশেষ করে দাউদকান্দির গৌরীপুর বাজার সংলগ্ন এলাকায় একসময়ের প্রশস্ত নদী এখন সরু নালায় পরিণত হয়েছে। নদীটির দুপাড়ের মাটি কেটেও চলছে দখল ও ভরাটের প্রতিযোগিতা, যা এর স্বাভাবিক প্রবাহকে পুরোপুরি রুদ্ধ করে দিয়েছে। অনেক অংশে নদীর সীমানা এমনভাবে হারিয়ে গেছে যে, নতুন করে জেগে ওঠা চরে চাষাবাদ পর্যন্ত শুরু হয়েছে, যা নদীর অস্তিত্বের জন্য এক চরম হুমকি।
দখলের পাশাপাশি, দূষণ কালা ডুমুর নদীকে আরও বেশি বিপন্ন করে তুলেছে। স্থানীয় বাড়িঘর, বাজার এবং ছোট শিল্প-কারখানার সব বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সরাসরি নদীর বুকে। পলিথিন, প্লাস্টিক, গৃহস্থালী আবর্জনা এবং পয়ঃনিষ্কাশনের বর্জ্যে নদীর পানি কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে উঠেছে।
বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে কচুরিপানা, যার নিচে চাপা পড়ে গেছে জলজ প্রাণের অস্তিত্ব। পানি বিষাক্ত হয়ে পড়ায় মাছের উৎপাদন প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এই দূষিত পানি কৃষি জমিতে সেচের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় আশপাশের চারটি উপজেলার ফসলি জমির ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। একদিকে যেমন ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে পুরো এলাকার পরিবেশ হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক ভারসাম্য।
দীর্ঘদিন ধরে নদীটি খনন না করার কারণেও এর তলদেশ ভরাট হয়ে গভীরতা কমে এসেছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই নদীর দুইকূল উপচে বন্যা দেখা দেয়, আবার গ্রীষ্মকালে এটি পানিশূন্য হয়ে ফসলের জমিতে সেচের তীব্র সংকট তৈরি করে। নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিতভাবে নদী শাসন এবং তদারকির অভাবে কুমিল্লার অন্যান্য নদীর মতোই কালা ডুমুর নদীও এখন অস্তিত্ব সংকটে। স্থানীয়রা দীর্ঘদিন ধরে নদীটি পুনঃখনন করে এর প্রাণ ফিরিয়ে আনার দাবি জানালেও এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর সরকারি উদ্যোগ দেখা যায়নি।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে নদীর অবদান অনস্বীকার্য। কালা ডুমুর নদী কেবল একটি জলপথ নয়, এটি হাজারো মানুষের জীবন-জীবিকা ও পরিবেশের রক্ষাকবচ। অবৈধ দখল, নির্বিচার দূষণ আর ভরাটের কারণে যদি এই ঐতিহ্যবাহী নদীটি হারিয়ে যায়, তবে তা কেবল পরিবেশেরই ক্ষতি করবে না, বরং কৃষি অর্থনীতিতেও নেমে আসবে ঘোর অন্ধকার। তাই, এখনই যদি অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ, বর্জ্য ফেলা বন্ধ এবং নদী খননের মাধ্যমে এর স্বাভাবিক গতিপথ ফিরিয়ে আনা না হয়, তবে অদূর ভবিষ্যতে কালা ডুমুর নদী মানচিত্র থেকে পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাবে, যা হবে আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ।