ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সুন্দরবন উপকূলে মাছ চাষে নীরব বিপ্লব

সুন্দরবন উপকূলে মাছ চাষে নীরব বিপ্লব

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল মৎস্যভান্ডার নামে খ্যাতবিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জসহ উপকূলে মাছ চাষ গত কয়েক বছরে অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক জলাশয়ও ক্রমেই কমছে। যুগ যুগ ধরে মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করা জেলে পরিবারের সদস্যরা এখন কম মাছ পেয়ে বিপন্ন হচ্ছেন। তবুও গ্রামীণ বাংলাদেশে মাছে ভাতে বাঙালি প্রবাদটি আজও সত্য। ছোট পুকুর খনন, ঘরে ঘরে হ্যাচারি তৈরি এবং দীর্ঘ ঘণ্টার পরিশ্রমের মাধ্যমে গ্রামের মানুষরা ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন এক সমৃদ্ধ মাছ চাষ শিল্প। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণে বাঙালির ভাতের থালা থেকে মাছ আজও হারায়নি।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে মোট উৎপাদন ৫০ লাখ টনেরও বেশি হয়েছে, যার প্রায় ৬০ শতাংশ এসেছে খামারভিত্তিক চাষ থেকে। ১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকে দেশে মোট মাছ উৎপাদনের মাত্র ১৬ শতাংশ আসত খামার থেকে। তখন দেশের মোট মাছের চাহিদার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই পূরণ হতো নদী, হাওর আর প্লাবনভূমি থেকে আহরিত প্রাকৃতিক মাছের মাধ্যমে। কিন্তু বর্তমানে এসব প্রাকৃতিক উৎসের উৎপাদন প্রায় একই থাকলেও, চাহিদার মাত্র ২৮ শতাংশ পূরণ হচ্ছে। বাকিটা আসে খামারভিত্তিক চাষ থেকে। দেশে প্রায় ৮ দশমিক ৭ লাখ হেক্টর পুকুর, খাল ও জলাভূমি খামারভিত্তিক মাছ চাষের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।

খামারভিত্তিক মাছ চাষ দেশের মোট জিডিপির ২ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ২২ শতাংশে অবদান রাখছে। এটি প্রায় ১৪ লাখ নারীসহ ২ কোটি মানুষের জীবিকার উৎস। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ মাছ উৎপাদনকারী দেশ। মাছ চাষের এই সাফল্য কেবল অর্থনৈতিক নয়, পুষ্টিগত দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। দেশীয় মানুষ প্রতিদিন গড়ে ৬৭ দশমিক ৮ গ্রাম মাছ খাচ্ছেন, যা সরকারের লক্ষ্যমান ৬০ গ্রাম অতিক্রম করেছে। গত দশকে চাষ হওয়া পাঙ্গাস ও তেলাপিয়ার মতো মাছ গ্রামীণ সাধারণ পরিবারগুলোর ভাতের থালায় ইলিশ, রুই, কাতলার মতো দামী দেশি মাছের স্থান দখল করেছে।

বাংলাদেশের পুকুর ও খালভিত্তিক মাছ চাষে গত তিন দশকে এক নীরব বিপ্লব ঘটেছে। এই সময়ে দেশের মোট মাছ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ২৫ গুণ, যা বিশ্বে একটি অনন্য সাফল্যের নজির। এর ফলে বাজারে মাছের সহজলভ্যতা বেড়েছে, দামও তুলনামূলকভাবে মানুষের সাধ্যের মধ্যে রয়েছে, ফলে সাধারণ মানুষের প্রোটিনের চাহিদা মেটানো সহজ হয়েছে। শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বব্যাপীও মাছ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্যে মাছ উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর চীন, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো এখন বৈশ্বিক মাছ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

২০২৩ সালে বাংলাদেশে মোট মাছ উৎপাদন দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৮ লাখ টনে, যার মধ্যে ৩২ লাখ টন এসেছে খামারভিত্তিক চাষ থেকে। এখন দেশের মোট উৎপাদিত মাছের প্রায় ৭৫ শতাংশ বাণিজ্যিকভাবে বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। এই পরিবর্তন প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে মাছ চাষ নিছক একটি পেশা নয়, বরং এক নীরব বিপ্লবের মাধ্যমে এটি গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে শুরু করে জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

এক সময় দেশের মাছের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সরবরাহ হতো নদী, হাওর ও প্লাবনভূমি থেকে। কিন্তু এখন প্রাকৃতিক উৎসের উৎপাদন প্রায় একই থাকলেও এর অংশ নেমে এসেছে মাত্র ২৮ শতাংশে। চাহিদার বাকি অংশ পূরণ হচ্ছে খামারভিত্তিক চাষ থেকে, যা বাংলাদেশের মাছ চাষের বিপ্লবকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।

মাছ চাষ শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ নয়, মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতেও বড় ভূমিকা রাখছে। চাষিরা লাভবান হয়ে পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল করতে পারছেন, জমি কিনছেন, বাড়ি তৈরি করছেন এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছেন। নারী উদ্যোক্তারাও এই খাতে এগিয়ে এসেছেন, যা মৎস্য শিল্পকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করেছে।

সাফল্যের বাস্তব উদাহরণও রয়েছে। যেমন-বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ সফিকুল ইসলাম লিজ নেওয়া কয়েকটি পুকুরে মাছ চাষ শুরু করেন। তার সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিশ্রমের ফলে তিনি লাভবান হন এবং সেই টাকা দিয়ে বাড়ি তৈরি ও জমি কিনে নিজের ব্যবসা আরও সম্প্রসারিত করেছেন। তার এই সাফল্য মৎস্য চাষিদের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অল্প পরিসরে মাছ চাষ শুরু করেছিলেন। আজ তার খামারে ৮ একর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ হচ্ছে এবং তিনি স্বাবলম্বী হয়েছেন। তার উদ্যোগের মাধ্যমে প্রায় ২০ জন বেকার নারী ও পুরুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হয়েছে। লাভলী ইয়াসমিনের এই সাফল্য অন্যান্য নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

সব মিলিয়ে বলা যায় মাছ চাষ বাংলাদেশের অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের এক নির্ভরযোগ্য খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এই সাফল্যকে আরও টেকসই করতে হলে নিরাপদ চাষাবাদ, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার এবং অ্যান্টিবায়োটিকের নিয়ন্ত্রিত প্রয়োগ নিশ্চিত করা এখন অতীব জরুরি। তবে এই সাফল্যের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে একটি নীরব সংকট, অ্যান্টিবায়োটিক ও রাসায়নিকের অতিরিক্ত ব্যবহার।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত