ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মার্কেটিং : চোখে পড়া নয়, মনে গেঁথে যাওয়ার যুদ্ধ

রাশেদুল ইসলাম সম্রাট
মার্কেটিং : চোখে পড়া নয়, মনে গেঁথে যাওয়ার যুদ্ধ

আধুনিক কর্পোরেট দুনিয়ায় মার্কেটিং এক রহস্যময় আলো-ছায়ার শক্তি যার বাস্তব গুরুত্ব অনুধাবনের চেয়ে, ভুল ব্যাখ্যারই ভিড় বেশি। অথচ এই শক্তিটিই প্রতিষ্ঠানকে কৌশলগত অবস্থান ও রাজস্বের মূল স্তম্ভে দাঁড় করিয়ে রাখে। ব্যবসার যেকোনো ফর্মস্টার্টআপ থেকে কর্পোরেট জায়ান্ট সবার স্কেল আলাদা হলেও লক্ষ্যগুলো এক অভিন্ন ত্রিকোণে এসে মেলে : ব্র্যান্ড ভ্যালু বৃদ্ধি, কোয়ালিটি লিড সংগ্রহ, ও আয়বৃদ্ধির ধারাকে ত্বরান্বিত করা। তবুও বাস্তবতা হলো এখনও অনেকেই মার্কেটিংকে সামান্য কিছু সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, গা-ছাড়া বিজ্ঞাপন চালানো, কিংবা ‘পরের মাসে দেখা যাবে’ জাতীয় হালকা কাজ মনে করেন। আরও বিভ্রান্তিকর হলো সেই চিরচেনা ভুল ধারণা : ‘মার্কেটিং তো সবাই করতে পারে!’ অথচ বাস্তবচিত্র ভিন্ন, এটি এক কৌশলনির্ভর, মনস্তাত্ত্বিক ও সৃজনশীলতার সমন্বয়ে গঠিত জটিল খেলা যেখানে বিশ্লেষণ, ধারাবাহিকতা ও ইনসাইটের ঘাটতি মানেই ব্যবসায়িক ইঞ্জিনের ছন্দপতন।

মার্কেটিং এত সহজ মনে হয় কেন? : এ প্রশ্নটির পেছনে রয়েছে আমাদের সমাজে গড়ে ওঠা কিছু ভ্রান্ত ধারণা ও দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড যেগুলো মার্কেটিংয়ের গভীরতা ও প্রকৃত অন্তর্নিহিত শক্তিকে আড়াল করে ফেলে। আমাদের চারপাশে এমন বহু কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়ত ঘটছে, যা একে ‘অতিরিক্ত সহজ’ হিসেবে তুলে ধরে : একজন ব্যক্তি নিজের প্রোফাইলে নিয়মিত পোস্ট করছেন এবং সেটি দেখে অনেকেই ভাবেন, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং বুঝি শুধু পোস্ট দেওয়ার নাম। গুগল অ্যাডস বা বুস্ট পোস্ট কয়েক ক্লিকে চালু করা যায়, ফলে মনে হয় বাজেট থাকলেই মার্কেটিং হয়ে যায়।

কারও যদি ন্যূনতম ডিজাইন স্কিল আর কিছু রচনাশৈলী থাকে, সেও ইমেইল ক্যাম্পেইন চালাতে পারে ফলে গোটা মার্কেটিং ডিসিপ্লিনটি নামিয়ে আনা হয় টুলনির্ভর এক ‘টেকনিক্যাল চর্চা’য়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মার্কেটিং আসলে কোনো টুল, ট্রেন্ড, কিংবা টেমপ্লেট নয়। এটি একটি সংবেদনশীল, সুপরিকল্পিত এবং বহুমাত্রিক বিশ্লেষণপ্রবণ প্রক্রিয়া, যার মূল উপাদান হলো মানুষের আচরণগত অন্তর্দৃষ্টি, তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ, মনস্তত্ত্ব এবং সুগভীর কৌশলগত চিন্তাধারা। এই ভুল ব্যাখ্যা শুধু বাজেট অপচয়ের ঝুঁকি বাড়ায় না বরং, একটি প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডভিত্তি নড়িয়ে দেওয়ার মতো পরিস্থিতিও তৈরি করতে পারে।

এই ‘সহজলভ্যতা’ থেকেই জন্ম নেয় এক বিপজ্জনক বিভ্রান্তি যার ফলে অনেকেই ভাবেন, যেকোনো সাধারণ ব্যক্তি জটিল মার্কেটিং অপারেশন পরিচালনা করতে সক্ষম। কিন্তু বাস্তবে, মার্কেটিং এমন এক শিল্প, যা একইসঙ্গে বিজ্ঞান, সাইকোলজি এবং স্ট্র্যাটেজির সংমিশ্রণ।

একটি সফল ক্যাম্পেইনের পেছনে লুকিয়ে থাকে বহুস্তর বিশ্লেষণ, কৌশল এবং প্রযুক্তির এক জটিল ও সূক্ষ্ম জাল, যা প্রতিষ্ঠানকে শুধু দৃশ্যমান করে না, বরং গ্রাহকের মনের গভীরে স্থায়ী জায়গা করে দেয়। এই স্তরগুলো প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং একে অন্যর পরিপূরক :

১. বাজার গবেষণা : সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হলো গ্রাহককে গভীরভাবে বোঝা তারা কারা, তাদের চাহিদা ও আচরণ কেমন, কেন তারা নির্দিষ্ট পণ্য বা সেবা বেছে নেবে। ভালো গবেষণা ছাড়া যে কোনো মার্কেটিং প্রচেষ্টা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়।

২. ব্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি : ব্র্যান্ডের আত্মপরিচয় ও মূল্য প্রস্তাব স্পষ্ট হওয়া জরুরি, যাতে তা প্রতিযোগিতায় নিজের অনন্য অবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং গ্রাহকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়।

৩. পজিশনিং ও মেসেজিং : সঠিক সময়ে, সঠিক টোন ও সঠিক বার্তা গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো একটি সূক্ষ্ম শিল্প। এভাবে ব্র্যান্ড তার মূল মূল্যবোধ ও প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট করে, যা গ্রাহকের মনে প্রভাব ফেলে।

৪. লিড জেনারেশন ও নার্চারিং : শুধুমাত্র আগ্রহ সৃষ্টি করলেই কাজ শেষ নয়; সেই আগ্রহীদের বিক্রয়ের পথে নিয়ে আসতে হবে ধাপে ধাপে পরিকল্পিত প্রক্রিয়ায়, যা দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে তোলে।

৫. গ্রাহক ধরে রাখা ও লয়্যালটি গঠন : একজন সন্তুষ্ট গ্রাহককে বারবার ফিরে আসতে অনুপ্রাণিত করাই যথেষ্ট নয় তাকে ব্র্যান্ডের প্রতি আবদ্ধ, বিশ্বস্ত অ্যাম্বাসেডরে পরিণত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ, যা মার্কেটিংয়ের সর্বোচ্চ সফলতা নির্দেশ করে।

এই প্রতিটি স্তর একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করে, প্রতিষ্ঠানকে শুধু বাহ্যিকভাবে পরিচিতি দেয় না; বরং গ্রাহকের চেতনায় একটি অটুট অবস্থান নিশ্চিত করে, যা প্রতিযোগিতার বাজারে দীর্ঘস্থায়ী সুবিধা এনে দেয়। মার্কেটিং নিয়ে আরেকটি চরম ভুল ধারণা হলো এর ফলাফল তাৎক্ষণিক হয়। একটি ভাইরাল ভিডিও, এক মাসের অ্যাড ক্যাম্পেইন বা ফ্ল্যাশ সেলের মাধ্যমে ব্যবসার রূপ বদলে যাবে, এই চিন্তাভাবনাটি বাস্তবের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান। একটি ব্র্যান্ডের প্রতি ট্রাস্ট তৈরি করতে মাসের পর মাস সময় লাগে।

মার্কেটিং বনাম সেলস : বিভাজন নয়, সংযোগ : অনেকে মার্কেটিং ও সেলসকে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বিভাগ হিসেবে দেখে, যেগুলো আলাদা আলাদা কাজ করে তবে আসল কথা হলো, এগুলো পরস্পরের পরিপূরক। সফল প্রতিষ্ঠানের জন্য এই দুই বিভাগের মধ্যে সমন্বয় অত্যাবশ্যক।

মার্কেটিং কাজ করে আগ্রহ সৃষ্টি ও মানসিক সংযোগ গড়ে তোলায়, আর সেলস সেই আগ্রহকে কাজে রূপান্তরিত করে, ডিল ক্লোজ করার মাধ্যমে। যেখানে এই দুই বিভাগ একই লক্ষ্য নিয়ে একইসঙ্গে কাজ করে, সেখানেই প্রতিষ্ঠানের প্রবৃদ্ধি, ব্র্যান্ড লয়্যালটি এবং গ্রাহক সন্তুষ্টির সেরা ফলাফল দেখা যায়।

যখন থামে ব্যবসা, তখনই চোখ পড়ে মার্কেটিংয়ে : সবচেয়ে বেদনাদায়ক সত্য হলো যখন ব্যবসার প্রবৃদ্ধি কমে যায়, বিক্রি ধীর হয়, তখন হঠাৎ করেই সবাই মার্কেটিংয়ের দিকে ফিরে তাকায়। অথচ যদি শুরু থেকেই এটিকে একটি কোর স্ট্র্যাটেজি হিসেবে দেখা হতো, অনেক ব্যর্থতা ও ক্ষতির আগেই প্রতিহত করা যেত। মার্কেটিংকে যদি এক লাইনে ব্যাখ্যা করা হয়, এটা কেবল বিক্রির জন্য নয়, বরং বিশ্বাস তৈরি করে ব্র্যান্ডকে মানুষের জীবনের অংশ বানানোর প্রক্রিয়া। পর্যাপ্ত বাজেটের সুসংগঠিত ব্যবহার, ডেটাচালিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, দক্ষ ও অভিজ্ঞ টিমের সমন্বয়, অবিচল ধৈর্য এবং ধারাবাহিকতা। এই উপাদানগুলো একইসঙ্গে মিলে এক সুদৃঢ় মার্কেটিং ইকোসিস্টেম গড়ে তোলে, যা প্রতিষ্ঠানকে টেকসই প্রবৃদ্ধির পথে নিয়ে যায়। তাই যখন কেউ বলে, ‘মার্কেটিং তো খুবই সহজ’ তখন আমাদের জানা উচিত, এটা আসলে কোনো সাধারণ কাজ নয়। মার্কেটিং শুধু চোখে পড়ার বা সাময়িক আকর্ষণের বিষয় নয়; এটি একটি গভীর, ধারাবাহিক এবং সুচিন্তিত কৌশল, যা মনের ভিতর গেঁথে যায় এবং দীর্ঘমেয়াদে ব্র্যান্ডের প্রতিচ্ছবি গড়ে তোলে। একটি সফল মার্কেটিং কৌশল মানে হলো গ্রাহকের অনুভূতি, মনস্তত্ত্ব এবং আচরণ বোঝা, তারপর সেই উপলব্ধিগুলোকে ধাপে ধাপে কাজে রূপান্তর করা। এটি হলো এমন একটি শিল্প যেখানে শুধু সৃষ্টিশীলতা নয়, বরং বিশ্লেষণ, ডেটা এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই পুরো প্রক্রিয়া ধৈর্য, নিখুঁত পরিকল্পনা এবং একনিষ্ঠতা ছাড়া সফল হওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই, মার্কেটিং কখনোই সহজ বা সরল ছিল না, এটি একটি অন্তর্নিহিত শিল্প যা প্রতিদিনের পরিশ্রম ও অনুধাবনের মাধ্যমে নির্মিত হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত