প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নতিকরণ সময়ের যৌক্তিক দাবি। দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ এই সড়কটিকে ৬ লাইনে উন্নতিকরণের দাবি জানিয়ে আসছে। বিগত সরকারের সময়ে এই মহাসড়কটি উন্নয়নের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা বলা হলেও কার্যত ও দৃশ্যমান কোনো কাজ চোখে পড়েনি।
বর্তমানে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি দুই লেনের। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক নামেই শুধু মহাসড়ক। বাস্তবে এটির প্রশস্ততা যেন কোনো গ্রামের সড়ক সমান! দেশের অন্যতম ব্যস্ততম ১৫৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কটির ৪০ কিলোমিটারজুড়ে প্রশস্ততা মাত্র ১৮ ফুট। অবশিষ্ট অংশের প্রস্থও মাত্র ৩৪ ফুট। সড়কটি সম্প্রসারণে প্রতিশ্রুতিতে পার হয়েছে বছরের পর বছর। দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং বান্দরবান অঞ্চলের কোটি মানুষের যোগাযোগের প্রধান পথ এই মহাসড়ক।
প্রতিদিন লক্ষাধিক লোক এই মহাসড়ক দিয়ে চলাচল করে। এই সড়ক শুধু স্থানীয়রা ব্যবহার করে তা নয়। এটি দেশের অর্থনীতি, পর্যটনশিল্প, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের মালামাল পরিবহন এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবিক ত্রাণ পৌঁছানোর কার্যক্রমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ দেশের অন্যতম ব্যস্ত এই সড়কটি অনেক জায়গায় পাড়ার গলির চেয়েও সরু। জাঙ্গালিয়ার মতো কিছু অংশ ঢালু ও আঁকাবাঁকা। আবার রাতে লবণের গাড়ি চলাচলের কারণে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেড়ে যায়। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সড়ক প্রশস্ত করার আশ্বাস মিললেও বাস্তবে কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পর্যটন নগর কক্সবাজারের কারণে এই সড়কে সব সময় যানবাহনের চাপ থাকে। ফলে প্রতিদিনই দীর্ঘ যানজটে পড়তে হয় যাত্রীদের। এ ছাড়া সরু মহাসড়ক হওয়ায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। তারা আরও জানান, এই মহাসড়ক মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই এই সড়কের কোথাও না কোথাও দুর্ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ অপ্রশস্ততা। মহাসড়কে ১৫টি দুর্ঘটনাকবলিত স্পট চিহ্নিত করেছে পুলিশ।
২০২৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত এ মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন শতাধিক মানুষ। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩ মাসে ২৭টি দুর্ঘটনায় ৪২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫৬ জন। এর আগে ২০২০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ৪ বছরে মারা গেছেন ২২৪ জন। এগুলো নিছক বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এরকম প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় জানমালের ক্ষতি হচ্ছে। বারবার অনুরোধ ও দাবি জানিয়েও এখনও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখতে পাইনি।
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পর্যটকের জন্য অন্যতম দর্শনীয় স্থান। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা কক্সবাজারে বেড়াতে আসেন। সরু সড়কের কারণে যেমন এই সড়কে দুর্ঘটনা ঘটে, তেমনই অন্য জেলার চালকদের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক নিয়ে কোনো ধারণা নেই। এ কারণে তারা বারবার দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। এদিকে, ২০২৬ সালে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হওয়ার কথা রয়েছে।
গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে কনটেইনার ও কাভার্ডভ্যানে পণ্য সারা দেশে সরবরাহ করা হবে। কিন্তু চারলেন বা ছয় লেনে সড়কটি সম্প্রসারণ না করলে এসব পণ্য কীভাবে পরিবহন হবে তা নিয়ে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি কারো কাছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা। একেকটি দুর্ঘটনা একেকটি পরিবারকে তছনছ করে দিচ্ছে। একটি দুর্ঘটনা চিরদিনের হাহাকার বয়ে আনছে পরিবারগুলোয়। পত্রিকায় পাতায় দুর্ঘটনার একটি ছবি কিংবা সংবাদ উঠছে, তার পরদিন আরেকটি নতুন দুর্ঘটনার খবরে আগের দিনের কথা সবাই ভুলে যাচ্ছে। কিন্তু যে মানুষ তার স্বজনকে হারাল, তার জীবনে নেমে আসছে ধস। সড়কে বেঘোরে প্রাণ যাওয়ার মতো করুণ নির্মম নিয়তি মেনে নেওয়া খুব কঠিন। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ প্রয়োজন। এখন এই মুহূর্তে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় সড়ক দুর্ঘটনা।
স্থানীয় মানুষের এই মুহূর্তের দাবি মরণফাঁদ থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনার বেশ কিছু কারণ রয়েছে- অপ্রশস্ত সড়ক, লোনাপানিতে মহাসড়ক পিচ্ছিল থাকা, অদক্ষ চালক, বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক বাঁক, ওভারটেকিং, মহাসড়কে নিষিদ্ধ ছোট যানবাহন চলাচল, ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত ওজন নিয়ে চলাচল এবং সড়কের দুপাশে উঁচু-নিচু জায়গা। কিন্তু দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় কারণ অপ্রশস্ত সড়ক। এ জন্যই সম্প্রতি কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে ছয় লেনে উন্নীত করার দাবি দিন দিন জোরালো হচ্ছে।
এই দাবিতে সর্বস্তরের মানুষ মানববন্ধন, বিক্ষোভসহ সভা-সমাবেশ করছে। ছয় লেনের সড়কের দাবিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কার্যালয়, সাতকানিয়া, লোহাগাড়ায় মানববন্ধন করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। উপযুক্ত কারণ বিবেচনায়, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার জেলার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সবার আগে এই মুহূর্তে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। মহাসড়কটি চার লেন বা ছয় লেন করা না হলে যানযট ও দুর্ঘটনা কোনোভাবেই কমানো যাবে না বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মুহাম্মদ জামাল উদ্দিন
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট