প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক ও উপকূলীয় দেশ। দক্ষিণে বিশাল বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের জন্য শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উৎস নয়, বরং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার এক বিশাল ভাণ্ডার। সমুদ্রকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক কার্যক্রম- যা আধুনিক পরিভাষায় নীল অর্থনীতি (Blue Economy) নামে পরিচিত- বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সমুদ্রের অবদান দিন দিন আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠছে। নীল অর্থনীতি বলতে সমুদ্র ও উপকূলীয় সম্পদের টেকসই ব্যবহারকে বোঝায়, যার মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। মাছ ধরা, নৌপরিবহন, বন্দর কার্যক্রম, জাহাজ নির্মাণ, পর্যটন, জ্বালানি সম্পদ, লবণ উৎপাদন- সবকিছুই নীল অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত। ২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের মাধ্যমে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের একটি বড় অংশে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে, যা নীল অর্থনীতির সম্ভাবনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। মৎস্যসম্পদ ও খাদ্য নিরাপত্তা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট মাছ উৎপাদনের প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ আসে সামুদ্রিক উৎস থেকে। মৎস্য খাত দেশের জিডিপিতে প্রায় ৩.৫ শতাংশ অবদান রাখে এবং কৃষিভিত্তিক জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশের বেশি আসে এই খাত থেকে। প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত।
সমুদ্র বাংলাদেশের মৎস্য খাতের প্রধান ভিত্তি। সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া ও অন্যান্য জলজ সম্পদ দেশের প্রোটিন চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উপকূলীয় জেলাগুলোর লাখো মানুষ মাছ ধরা, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত। সামুদ্রিক মাছ ও হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, যা জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে।
বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশ সমুদ্রপথে সম্পন্ন হয়। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দেশের প্রধান বাণিজ্যিক প্রবেশদ্বার। সম্প্রতি পায়রা বন্দরের উন্নয়ন দেশের বন্দর সক্ষমতা আরও বাড়িয়েছে। দক্ষ নৌপরিবহন ব্যবস্থা পণ্য পরিবহনের খরচ কমায়, বাণিজ্য সহজ করে এবং শিল্পায়নকে ত্বরান্বিত করে। এর ফলে অর্থনীতির চাকা দ্রুত ঘুরতে থাকে। জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজ ভাঙা শিল্পবিশ্বের মোট জাহাজ ভাঙা শিল্পের প্রায় ৩০ শতাংশ বাংলাদেশে সম্পন্ন হয়। এই খাত থেকে দেশের মোট লোহা চাহিদার প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ পূরণ হয় এবং প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৩০-৪০ হাজার শ্রমিক কর্মসংস্থান পায়। জাহাজ নির্মাণ শিল্প থেকেও বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় করে।
বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙা শিল্প বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ। এই খাত থেকে লোহা ও অন্যান্য ধাতব কাঁচামাল পাওয়া যায়, যা নির্মাণ ও শিল্প খাতে ব্যবহৃত হয়। একইসঙ্গে দেশীয় জাহাজ নির্মাণ শিল্পও বিকশিত হচ্ছে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রপ্তানি আয়ে অবদান রাখছে। তবে পরিবেশ ও শ্রম নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এই শিল্পকে টেকসই করা জরুরি। উপকূলীয় ও সামুদ্রিক পর্যটন পরিসংখ্যান বলছে, কক্সবাজারে প্রতিবছর গড়ে ১ কোটিরও বেশি দেশি পর্যটক ভ্রমণ করে। পর্যটন খাত জাতীয় জিডিপিতে প্রায় ৩ শতাংশের কাছাকাছি অবদান রাখে এবং এই খাতের সঙ্গে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে ৩০ লাখের বেশি মানুষ যুক্ত।
কক্সবাজারের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, কুয়াকাটা- এসব পর্যটনকেন্দ্র দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। পর্যটন খাত হোটেল, পরিবহন, হস্তশিল্প ও সেবা খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙা করে। পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব পর্যটন নীল অর্থনীতির একটি সম্ভাবনাময় দিক।জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার। বিশেষজ্ঞদের মতে, বঙ্গোপসাগরের তলদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের সম্ভাব্য মজুত কয়েক ট্রিলিয়ন ঘনফুট (TCF) হতে পারে, যা ভবিষ্যতে দেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বঙ্গোপসাগরের তলদেশে প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের সম্ভাবনা রয়েছে। এসব সম্পদের অনুসন্ধান ও উত্তোলন সঠিকভাবে করা গেলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদার হবে এবং আমদানিনির্ভরতা কমবে। পাশাপাশি সমুদ্রভিত্তিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি- যেমন অফশোর বায়ু ও তরঙ্গ শক্তি- ভবিষ্যতে অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। পরিবেশ সুরক্ষা ও জলবায়ু সহনশীলতা সমুদ্র অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নের জন্য পরিবেশ সুরক্ষা অপরিহার্য। দূষণ নিয়ন্ত্রণ, অতিরিক্ত মাছ ধরা রোধ, ম্যানগ্রোভ বন সংরক্ষণ- এসব উদ্যোগ উপকূলীয় জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে। সুন্দরবন প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে দেশকে সুরক্ষা দেয়, যা অর্থনৈতিক ক্ষতি কমাতে সহায়ক।
চ্যালেঞ্জ ও করণীয়-
যদিও সম্ভাবনা বিপুল, তবু নীল অর্থনীতিতে দক্ষ মানবসম্পদ, গবেষণা, প্রযুক্তি ও সমন্বিত নীতির ঘাটতি রয়েছে। অবৈধ মাছ ধরা, পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা দরকার। সমুদ্র গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ালে এই খাত থেকে সর্বোচ্চ সুফল পাওয়া সম্ভব। একইসঙ্গে ডিজিটাল বন্দর ব্যবস্থাপনা, স্মার্ট শিপিং ও আন্তর্জাতিক ট্রানজিট সুবিধা চালু হলে বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। এতে বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং রপ্তানি আয়ের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। পরিকল্পিত ব্যবহার, পরিবেশ সুরক্ষা ও দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সমুদ্রই হতে পারে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের প্রধান ভিত্তি।