ঢাকা শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ৪ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নদী দখল ও পরিবেশ বিপর্যয়

তানিয়া খান
নদী দখল ও পরিবেশ বিপর্যয়

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীকে কেন্দ্র করেই এ ভূখণ্ডে গড়ে উঠেছে সভ্যতা, কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্য। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই নদীগুলোই আজ সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। নিত্য দূষণ, দখল আর অপরিকল্পিত নগরায়ণে নদী ক্রমেই আক্রান্ত হচ্ছে। গত দুই দশকে শিল্পকারখানা ও বাণিজ্যের প্রসারের অজুহাত দেখিয়ে নদী দখল যেমন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে ভয়াবহ হারে দূষণ।

নদীতে পানির প্রবাহ ঠিক রাখা, দূষণমুক্ত রাখা এবং দখল রোধে জড়িত রয়েছে ২৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। নদীর অবৈধ দখল ও পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে আছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনও। তবুও নদী রক্ষা পাচ্ছে না। প্রশ্ন জাগে- এত প্রতিষ্ঠান থাকার পরও কেন নদী বাঁচছে না?

গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সবাই আমরা নির্বিচারে নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলছি। প্লাস্টিক পলিথিনের মতো মারাত্মক বর্জ আমরা নিয়মিতই নদীতে ফেলি। শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ছে। উজান থেকে নেমে আসা পলি নদীতে জমে নাব্যতা কমাচ্ছে। এসব কারণে একদিকে জলজ প্রাণী হুমকির মুখে পড়ছে, অন্যদিকে নদী দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে শাখা-প্রশাখা ও উপনদী মিলিয়ে কম-বেশি ৭০০টি নদী রয়েছে। কিন্তু দেশের শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অন্তত ২৮টি নদনদী দখল ও দূষণের কারণে এখন মৃতপ্রায়। ৫৩ জেলার নদী ও খালের বিভিন্ন অংশ দখল করেছে ১০ হাজারেরও বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের মতে, প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। যদি আমার বুড়িগঙ্গার দিকেই তাকায়, তবে বুঝতে পারব এটার বর্তমান ভয়াবহ অবস্থা। পূর্বে এই বুড়িগঙ্গার প্রতি আকৃষ্ট হয়েই মুঘলরা এখানে জাহাঙ্গীর নগর বা ঢাকা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। কিন্তু যানবাহনের ধোয়া, শিল্প কারখানার বর্জ, বাসগৃহের নোংরা পানি, পলিথিন আর প্লাস্টিকের স্তুপ, এটাকে মৃত্যু নদীতে পরিনত করেছে

নদীর ধারে গড়ে উঠেছে বড় বড় কলকারখানা। নদীর বুকে নির্মিত হয়েছে শত শত বাঁধ। প্রয়োজনমতো নদীকে ব্যবহার করা হচ্ছে, আবার প্রয়োজন শেষ হলে ভুলে যাওয়া হচ্ছে। প্রভাবশালীরা নদী ভরাট করে দখল করার উৎসবে মেতে উঠেছে। ফলে ‘নদীমাতৃক দেশ’ অভিধানটি আজ অর্থহীন হয়ে পড়ছে। বাস্তবে বাংলাদেশ এখন নদীবৈরী দেশে পরিণত হয়েছে।

বিশেষ করে শহরাঞ্চলে নদী ও খালের তীর করে গড়ে উঠেছে বাড়ি, দোকান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কোথাও কোথাও নদীর তীরেই বসানো হয়েছে অবৈধ হাটবাজার। এক প্রকার প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গই নদী দখল করে এগুলো করছে। অভিযোগ রয়েছে, নদী-খালের জমি দখলে স্থানীয় ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও রাজনীতির যোগসুত্র রয়েছে। এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

নদী রক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর ভূমিকা স্পষ্ট করতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরকে নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। ভূমি মন্ত্রণালয়কে জলাভূমির লিজ বন্ধ করতে হবে। মৎস্য অধিদপ্তরকে জলাভূমি রক্ষায় সক্রিয় হতে হবে। আন্তঃদেশীয় নদীর পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বের করতে হবে।

নদী রক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারকে দ্রুত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পের কাজ ত্বরান্বিত করতে হবে। একই সঙ্গে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। নদী দখল ও দূষণের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

বর্তমানে দণ্ডবিধি, পরিবেশ আইন ও পানি আইনে নদী দখল ও দূষণের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো- এই আইনগুলোর সঠিক প্রয়োগ হয়নি। নদী দখল ও দূষণের দায়ে কাউকে কারাদণ্ড পেতে হয়নি। শুধু কিছু জরিমানা করেই দায় শেষ করা হয়েছে।

আমাদের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য- সবকিছুর সঙ্গে নদী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হাজার বছর ধরে নদী আমাদের কৃষি, অর্থনীতি ও প্রকৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। একজন মা যেমন সন্তানকে আগলে রাখেন, নদীও তেমনি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। এই মা ভালো না থাকলে আমরা কেউই ভালো থাকতে পারি না। তাই নদী ও পরিবেশ বাঁচাতে এখনই সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। নদী রক্ষা না করলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎও রক্ষা পাবে না। সর্বশেষ আমাদের প্রত্যেকেই নদী রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের একা পদক্ষেপে কাজ হবে না, নিজ নিজ দায়িত্বে প্রত্যেকেই এই নদী রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভমিকা রাখা এবং সঠিক পদক্ষেপই পারে নদীকে বাচিয়ে রাখতে।

তানিয়া খান

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত