প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫
আমাদের সমাজে সর্বপ্রথম যে বিষয়টি গুরুত্ব পায় তা হলো- ‘মানুষ কি বলবে?’ সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত হয়, যার মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত ক্ষেত্র হলো মানসিক স্বাস্থ্য। আমরা ধরে নিই, মানুষ যদি আমাদের সামনে হাসিখুশি থাকে, কাজ চালিয়ে যায়, আমাদের প্রয়োজন পূরণ হয়- তাহলে তার ভিতরের অনুভূতি নিয়ে ভাবার আর প্রয়োজন কী? অথচ বাস্তবতা হলো, একটি সমাজের সার্বিক সফলতা নির্ভর করে তার প্রতিটি মানুষের মানসিক সুস্থতার উপর। প্রত্যেক সমাজ গড়ে ওঠে পরিবারকে কেন্দ্র করে। পরিবারের একজন সদস্য মানসিক সমস্যায় পড়লে তার প্রভাব ধীরে ধীরে পুরো পরিবারে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে তা সমাজের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এভাবে অদৃষ্টপূর্বভাবে আমরা একটি অসুস্থ জনগোষ্ঠী তৈরি করছি, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়ংকর সংকেত বহন করছে।
গবেষণা বলছে- বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগা প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ মানুষ কোনো চিকিৎসাই গ্রহণ করে না। সাম্প্রতিক জাতীয় জরিপে দেখা গেছে, Generalized Anxiety Disorder (GAD)-এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাত্র ৩.৯ শতাংশ পেশাদার সহায়তা নিয়েছেন। সামাজিক কুসংস্কার, লজ্জা, সচেতনতার অভাব ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার স্বল্পতার কারণে বহু মানুষ নিজের সমস্যাকে আড়াল করে রাখে। ফলে চিকিৎসাহীনতার প্রকৃত হার আরও বেশি হতে পারে।
দেশ নানা সংকটে জর্জরিত থাকলেও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা ‘অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা’- এমন ভুল ধারণা এখনও অনেকের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র হলো, একটি সুস্থ সমাজ গড়ার জন্য মানসিকভাবে সুস্থ জনগোষ্ঠী অপরিহার্য। সেই লক্ষ্যে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা, টিভি-মিডিয়া-সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে নিয়মিত প্রচারণা চালানো এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্যশিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। সমাজের কুসংস্কার- মানসিক রোগকে ‘দুর্বলতা’ বা ‘ভাগ্যের দোষ’ বলা- থেকে দ্রুত বের হয়ে আসতে হবে। এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে যে কেউ মানসিক সমস্যার কথা নির্ভয়ে বলতে পারে।
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক অসুস্থতা ভয়ংকরভাবে বাড়ছে। এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে- একটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮০.৮ শতাংশ উদ্বেগ, ৭৭.৯ শতাংশ বিষণ্ণতা, এবং ৬৯.৭ শতাংশ মানসিক চাপের লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে। করোনাকালীন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ‘extremely severe depression’ ও ‘extremely severe anxiety’-এর হার যথাক্রমে প্রায় ২৩ শতাংশ এবং ২০ শতাংশ পাওয়া গেছে। বেশিরভাগ গবেষণায় দেখা যায়- আত্মহত্যার একটি বড় অংশই বিভিন্ন মানসিক রোগের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। একটি ‘psychological autops’ গবেষণায় আত্মহত্যার প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে মানসিক অসুস্থতাকে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই বাস্তবতায় স্কুল-কলেজে অন-সাইট কাউন্সেলর নিয়োগ বাধ্যতামূলক করার প্রয়োজনীয়তা এখন সময়ের দাবি। শিক্ষা জীবনের চাপ, পরীক্ষা, সম্পর্ক বা পারিবারিক টানাপোড়েন-এসব বিষয়ে সাহায্য নেওয়াকে স্বাভাবিক করা উচিত। পাশাপাশি, কর্মক্ষেত্রে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম, পেইড ছুটি, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং কর্মীদের সুস্থতা মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য। বাংলাদেশে মনোবিজ্ঞানীদের সেশন ফি এখনও অধিকাংশ মানুষের সামর্থ্যের বাইরে। তাই মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে যুক্তিসঙ্গত, জনসাধারণের নাগালে আনা এবং সরকারিভাবে ভর্তুকি দেওয়ার মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
রাফিয়া সুলতানা
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়