প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫
বাংলাদেশের হাজার বছরের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বর্তমানে এক গভীর সংকটের মুখোমুখি, যেখানে লোকনৃত্য, লোকসংগীত এবং ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পের মতো অমূল্য উপাদানগুলো বিশ্বায়ন, প্রযুক্তির আগ্রাসন ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছে, এবং এই প্রেক্ষাপটে জাতি আজ তার সাংস্কৃতিক শেকড় সন্ধানে এক কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত। আমাদের সংস্কৃতির এই মূল ভিত্তিগুলোর মধ্যে লোকসংগীত, যা বাউল, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারি ও সারির মতো বিভিন্ন ধারায় গ্রামীণ মানুষের জীবনবোধ, আধ্যাত্মিকতা ও প্রেম-বিরহের চিরায়ত সুর বহন করত, তা এখন শহুরে চটকদার পপ ও ফিউশন সঙ্গীতের দাপটে ক্রমশ কোণঠাসা; এই সঙ্গীতগুলোর অন্তরঙ্গ আবেদন বিশ্বায়নের আগ্রাসনে নির্মিত দ্রুত পরিবর্তনশীল মিডিয়া কাঠামোর কাছে হেরে যাচ্ছে। একসময় গ্রামে-গঞ্জে উৎসব-পার্বণে যে লোকনৃত্য (যেমন: গম্ভীরা, আলকাপ, লাঠিখেলা) প্রাণ সঞ্চার করত, টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় তা এখন শুধুই স্মৃতির পাতায় সীমাবদ্ধ; তরুণ প্রজন্ম এই নৃত্যশৈলীগুলো শেখা বা চর্চা করার আগ্রহ হারাচ্ছে, ফলে ঐতিহ্যবাহী পরিবেশকরাও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন, যা এই শিল্পগুলোর পুনরুত্থানের পথকে আরও কঠিন করে তুলেছে। একইসঙ্গে, আমাদের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পগুলো (যেমন: নকশি কাঁথা, মৃৎশিল্প বা কুমারদের হাতে তৈরি মাটির জিনিসপত্র, বাঁশ ও বেতের শিল্পকর্ম, জামদানি, মসলিন) মারাত্মকভাবে বাজারের প্রতিযোগিতার শিকার, যেখানে সস্তা ও দ্রুত উৎপাদিত বিদেশী পণ্যের ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটেছে; ফলে বংশপরম্পরায় এই শিল্পগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকা কারুশিল্পীরা আর্থিক সংকটে পড়েছেন এবং এই পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন, যার কারণে কারিগরদের দক্ষতা ও জ্ঞানও বিলুপ্ত হচ্ছে।
এই সাংস্কৃতিক সংকটের মূল কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করেছেন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কৃতির দুর্বল অবস্থান এবং বাজার অর্থনীতির নির্মম চাপ। বিশেষত, বিশ্বায়নের প্রভাবে পশ্চিমা সংস্কৃতি এবং ভারতীয় হিন্দি সিরিয়ালের আগ্রাসী প্রচারণার ফলে স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি নতুন প্রজন্মের আসক্তি ও আগ্রহ কমে যাওয়ায় তারা নিজেদের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে; আধুনিক শিক্ষা এবং ক্যারিয়ার সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে তরুণরা এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে দেখতে চাইছে না, ফলে এই শিল্পগুলোর ধারাবাহিকতা ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়াও, লোকশিল্পীদের জন্য পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা না থাকায়, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই পেশায় আসতে চাইছে না। ফলে, সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক অবকাঠামো ভেঙে পড়ছে, যা শেষ পর্যন্ত একটি সাংস্কৃতিক মূলহীনতা বা ‘কালচারাল রুটলেসনেস’-এর জন্ম দিচ্ছে। তবে, এই বিলুপ্তি ঠেকানোর সংগ্রামও থেমে নেই; কিছু বেসরকারি সংস্থা (NGO), সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং ব্যক্তি উদ্যোগের মাধ্যমে বাউল গান বা লোকনৃত্যের কর্মশালা আয়োজন করা হচ্ছে, যা কিছুটা হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে; সরকারের পক্ষ থেকে শিল্পকলা একাডেমি এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) কিছু উদ্যোগ নিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল এবং প্রায়শই সমন্বয়হীনতার শিকার হয়।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য, লোকশিল্প ও কারুশিল্পকে কেবল ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে না দেখে, বরং তাকে একটি অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ক্ষেত্র হিসেবে দেখতে হবে; এর জন্য প্রয়োজন ঐতিহ্যবাহী পণ্যগুলোর মান উন্নয়ন ও আধুনিক চাহিদা অনুযায়ী ডিজাইনে পরিবর্তন এনে বৈশ্বিক বাজারে তা তুলে ধরা এবং শিক্ষাব্যবস্থার সকল স্তরে লোক সংস্কৃতিকে বাধ্যতামূলক পাঠ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা, যাতে নতুন প্রজন্ম নিজেদের কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে, এবং এইভাবে তাদের নিজেদের সাংস্কৃতিক শেকড়ের সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করতে পারে। কেবলমাত্র একটি সুসংগঠিত রাষ্ট্রীয় নীতি, শিল্পীদের জন্য পেনশন ও স্বাস্থ্য সুবিধার মতো সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং গণমাধ্যমগুলোতে দেশীয় লোক সংস্কৃতির প্রচার বাড়ানোর মাধ্যমেই আমাদের এই অমূল্য ঐতিহ্যকে বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা সম্ভব, যা বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জাতীয় পরিচিতিকে দৃঢ় করবে।
জান্নাতুল ফেরদৌস জেরিন
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ