লাখ লাখ মুসল্লির আমিন আমিন ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল কহর দরিয়াখ্যাত টঙ্গীর তুরাগ নদের তীর ও তার আশপাশের এলাকা। মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, শান্তি, কল্যাণ, হেদায়েত, আরোগ্য লাভ ও কবরবাসীদের মাগফিরাত কামনায় আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম ধাপ। গতকাল রোববার সকাল ৯টা ১১ মিনিটে মোনাজাত শুরু হয়ে শেষ হয় ৯টা ৩৫ মিনিটে। প্রথম পর্বের প্রথম ধাপের আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন তাবলিগ জামাত বাংলাদেশের শীর্ষ মুরব্বি কাকরাইল জামে মসজিদের পেশ ইমাম ও খতিব মাওলানা জুবায়ের আহমেদ। মোনাজাতে মুসলিম উম্মাহর শান্তি কামনা করে প্রার্থনা করা হয়। এছাড়া মানুষের মধ্যে হেদায়েত, আরোগ্য লাভ, কবরবাসীদের মাগফিরাত কামনা করা হয়।
এসময় তুরাগ নদের তীর ও তার আশপাশের এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। যত দূর চোখ যায় ততদূর পর্যন্তই শুধু মুসল্লিদের ঢল দেখা যায়। লাখো মুসল্লির কাতারে শরিক হয়ে পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে হাত পেতেছেন এসব মানুষ। মোনাজাতে অংশ নিতে ভোর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে দলে দলে টঙ্গীর দিকে যাত্রা করেছেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বিভিন্ন পেশার হাজার হাজার মুসল্লি ময়দানের দিকে আসছেন। বিভিন্ন যানবাহন ও নৌপথে এবং পায়ে হেঁটে মুসল্লিরা যোগ দেন ইজতেমা ময়দানে। ময়দানের আশপাশে অলিগলি, বাড়ি ও কলকারখানার ছাদে, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ফ্লাইওভারসহ বিভিন্ন সড়ক ও খালি জায়গায় পলিথিন, পত্রিকা, পাটি ও জায়নামাজ বিছিয়ে অবস্থান নেন। এদিন বাদ ফজর থেকে ভারতের মাওলানা আব্দুর রহমান হেদায়েতি বয়ান করেন। যারা এখান থেকে চিল্লা, তিন চিল্লার জন্য জামাতে বের হবেন, তারা জামাতে গিয়ে কি আমল করবে এবং মহল্লায় যারা এখান থেকে ফিরে যাচ্ছেন তারা নিজ এলাকায় গিয়ে কি আমল করবে তার দিকনির্দেশনামূলক বয়ান করেন তিনি। মাওলানা আব্দুল মতিন তা বাংলায় অনুবাদ করছেন। এ বয়ানের পরেই ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা সাহেব নসিহতমূলক বয়ান করেন। তা বাংলায় অনুবাদ করবেন মাওলানা জুবায়ের। আখেরি মোনাজাতের আগে সকাল ৬টা থেকে ঢাকার ৩০০ ফিটের মাথায়, ধউর ব্রিজের মাথায় এবং ভোগড়া বাইপাস মোড় থেকে ইজতেমাগামী সব যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়। গত বৃহস্পতিবার বাদ মাগরিব ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলার আম বয়ানের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইজতেমার ৫৮তম জমায়েত শুরু হয়। প্রথম পর্বের তিন দিনের এই ইজতেমায় লাখো মুসল্লি অংশ নিয়েছেন। গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয় দেশের বৃহৎ জুমার জামাত, যেখানে মুসল্লিদের ঢল নামে।
আয়োজকরা জানিয়েছেন, বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব দুই ধাপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথম ধাপে ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪১ জেলা ও ঢাকার একাংশের মুসল্লিরা অংশ নিয়েছেন। দ্বিতীয় ধাপে ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২২ জেলা ও ঢাকার বাকি অংশের মুসল্লিরা অংশ নেবেন। প্রথম পর্ব শেষ হওয়ার আট দিন পর ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে দ্বিতীয় পর্ব, যা আয়োজন করবেন ভারতের মাওলানা সাদ অনুসারীরা। ১৬ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে ২০২৫ সালের বিশ্ব ইজতেমার সমাপ্তি ঘটবে। এদিকে বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত চলাকালে উড়ন্ত একটি ড্রোন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হঠাৎ নিচে পড়ে গেলে আতঙ্কে মুসল্লিরা ছোটাছুটি শুরু করেন। সে সময় পড়ে গিয়ে পদদলিত হয়ে কমপক্ষে ৪০ জন আহত হয়েছেন। আহতরা হলেন- রাজধানীর দক্ষিণ খানের আবুল কালাম; রামপুরার আব্দুল করিম; বাড্ডার সাইদুল ইসলাম; নারায়ণগঞ্জের আল-আমিন, আনোয়ার হোসেন, আমজাদ; টঙ্গীর ওবায়দুল্লাহ, কবির হোসেন, নাজিম উদ্দিন, বাসেত, খোকন, মোবিন, আয়নাল হক, জহুরুল; টঙ্গীর পাগাড় এলাকার জাফর উদ্দিন, আরিচপুরের কবির হোসেন, আউচপাড়ার মকবুল হোসেন; আব্দুল্লাহপুরের রায়হান, সোহাগ বানু; গাজীপুরের জয়নাল, কাওসারুল আলম, গাজীপুরের তারগাছ এলাকার রাতুল; জয়দবেপুরের জয়নাল আবদেীন, জয়দেবপুর চৌরাস্তা এলাকার মোশারফ, মাছিমপুর এলাকার কোরবান আলী; হবিগঞ্জের সিজিল; টাঙ্গাইলের গোপালপুরের সাইফুল ইসলাম, সালামত, মোস্তাকিম; গাজীপুরের শ্রীপুরের মাওনার আমজাদ সরকারের ছেলে জুয়েল; সিলেটের গোলাপগঞ্জের জহুরুল ইসলাম; ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার আলী নেওয়াজ; নাটোরের আফতাব উদ্দিন, মামুন হোসেন; চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমান। তাদের টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আহতদের মধ্যে টঙ্গীর পাগাড় এলাকার জাফর উদ্দিন বলেন, ‘আমি মোনাজাত করছিলাম। হঠাৎ সামনে হইচই শুরু হলে মুসল্লিরা ছোটাছুটি করতে থাকেন। ধাক্কাধাক্কির মধ্যে পড়ে গিয়ে আমি আহত হই।’
নারায়ণগঞ্জ পুলিশ লাইন্স এলাকার আয়রন মার্কেটের ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এমন পরিস্থিতির জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। সবাই দৌড়াদৌড়ি শুরু করলে আমিও সরে পড়ার চেষ্টা করি। কিন্তু ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়ে মারাত্মক আঘাত পাই।’ টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শাকিল বিন সিরাজ জানান, এখন পর্যন্ত ৪০ জনকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাখা হয়েছে। বেশ কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের টঙ্গী পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফরিদ হোসেন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘ড্রোন আতঙ্কে ছোটাছুটি করে দৌড়াতে থাকলে পড়ে গিয়ে আহতের ঘটনা ঘটেছে।’