বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক আপসহীন নাম বেগম খালেদা জিয়া। যিনি ১৯৮৪ সাল থেকে বিএনপি চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যাওয়ার পর রাজনীতি থেকে অনেকটা দূরে সরে গিয়েছিলেন তিনি। এর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে নানা জটিল রোগে ভুগছিলেন। রাজনীতিতে তার অনুপস্থিতিতে তারই বড় ছেলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়ে দল পরিচালনা করতে থাকেন। এখন পর্যন্ত তারেক রহমানই সেই দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মামলা থেকে খালাস পেয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান খালেদা জিয়া। লন্ডনে উন্নত চিকিৎসায় এখন অনেকটাই সুস্থ সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। চিকিৎসা শেষে লন্ডন থেকে আজ দেশে ফিরছেন তিনি।
দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও নানা বিষয়ে আলোচনায় ছিলেন খালেদা জিয়া। তবে এবার নতুন করে আলোচনায় আসছেন তিনি। ফের রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া- এমন গুঞ্জন রয়েছে রাজনৈতিক মহলে। বিশেষ করে, চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার ঘটনায় তিনি আরও বেশি আলোচনায় রয়েছেন।
জানা গেছে, বিগত দিনের চেয়ে অনেকটা সুস্থ খালেদা জিয়া এবার রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারেন। সভা-সমাবেশে উপস্থিত হয়ে বক্তব্যও দিতে পারেন। এতে দলের নেতাকর্মীরাও উজ্জীবিত হচ্ছেন। দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে এক আপসহীন নাম। তিনি গণতন্ত্র ও মানুষের কল্যাণে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। আবার তিনি সুস্থ হয়ে রাজনীতিতে ফিরছেন, এ খবর আমাদের জন্য খুবই আনন্দের। দলটির একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র থেকে এমন তথ্য জানা গেছে।
দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে আজ লন্ডন থেকে দেশে ফিরছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। কাতারের আমিরের পাঠানো একটি বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সকালে তিনি ঢাকায় পৌঁছাবেন। খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী হিসেবে থাকবেন তারেক রহমানের সহধর্মিণী ডা. জোবায়দা রহমান ও আরেক পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান। এছাড়া খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এজেডএম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এনামুল হক চৌধুরী, এপিএস মাসুদুর রহমান ও দুই গৃহপরিচারিকা ফাতেমা বেগম ও রূপা হকও সফরসঙ্গী হিসেবে থাকবেন।
বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসভবন ফিরোজা পর্যন্ত খালেদা জিয়ার যাত্রাপথে থাকবে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা। এছাড়া নেতাকর্মীদের জন্যও জারি করা হয়েছে কড়া নির্দেশনা। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কেউ যেন বিমানবন্দর বা চেয়ারপারসনের বাসভবনে প্রবেশ না করে। নেতাকর্মীদের জাতীয় ও দলীয় পতাকা হাতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাতে বলা হয়েছে। খালেদা জিয়ার গাড়ির সঙ্গে মোটরসাইকেল ও হেঁটে চলার ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়, বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনকে অভ্যর্থনার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থান করতে বলা হয়েছে। উত্তর বিএনপি থাকবে বিমানবন্দর থেকে লা মেরিডিয়ান পর্যন্ত, ছাত্রদল লা মেরিডিয়ান থেকে খিলক্ষেত পর্যন্ত, দক্ষিণ বিএনপি রেডিসন হোটেল থেকে আর্মি স্টেডিয়াম, স্বেচ্ছাসেবক দল আর্মি স্টেডিয়াম থেকে বনানী কবরস্থান পর্যন্ত। এছাড়া কৃষক দল, শ্রমিক দল, ওলামা দল, তাঁতী দল, জাসাস, মৎস্যজীবী দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, পেশাজীবী ফোরাম, মহিলা দল ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির নেতারাও নির্ধারিত রুটে অবস্থান নেবেন।
দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, খালেদা জিয়া নতুন একটি টয়োটা ক্রাউন গাড়িতে চড়েই ফিরোজায় পৌঁছাবেন। তার নিরাপত্তার জন্যও পুলিশের সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
সূত্রমতে, স্বামী তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনের উদ্দেশে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন ডা. জুবাইদা রহমান। এরপর কেটে গেছে ১৭টি বছর। স্বামী তারেক রহমান ও একমাত্র সন্তান জায়মা রহমানকে নিয়ে লন্ডনে ছিলেন। অবশেষে শাশুড়ি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেশে ফিরছেন জুবাইদা রহমান। এদিকে দেশে ফেরার পর জুবাইদা রহমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বরাবর চার স্তরের নিরাপত্তা চেয়ে একটি চিঠি দিয়েছে বিএনপি। গত ৩০ এপ্রিল দেওয়া ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পরিবারের সদস্য এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সহধর্মিণী হিসেবে ডা. জুবাইদা রহমানের জীবনে নিরাপত্তার ঝুঁকি রয়েছে। তিনি ঢাকায় অবস্থানকালে ধানমন্ডিতে তার পৈতৃক বাসভবন ‘মাহবুব ভবনে’ থাকবেন। চিঠিতে ডা. জুবাইদা রহমানের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চারটি ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- একজন সশস্ত্র গানম্যান নিয়োগের সঙ্গে গাড়িসহ পুলিশ প্রটেকশন। এছাড়া বাসায় পুলিশ প্রহরা এবং বাসার প্রবেশপথে আর্চওয়ে স্থাপনের জন্যও অনুরোধ জানানো হয়।
তারেক রহমানকে নিয়ে দেশে ফেরার যে গুঞ্জন ছিল তা গুঞ্জনই রয়ে গেল। এ অবস্থায় খালেদা জিয়ার পাশাপাশি দুই পুত্রবধূ রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন কি না- তা নিয়েও নানা প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানের বিকল্প হিসেবে জুবাইদা রহমান দলের হাল ধরবেন কি না- তা নিয়ে চর্চা কম হয়নি। তবে এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে কখনও কিছু স্পষ্ট করে বলা হয়নি। চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া এবার লন্ডনে গেলে অনেক দিন পর আবার সামনে আসেন জুবাইদা। সব সময় তাকে শাশুড়ির সঙ্গে দেখা গেছে। বাসায়ও শাশুড়িকে সেবা করেছেন। দেশে ফেরার সময়ও তিনি সঙ্গ দিচ্ছেন। তিনি বেশ কিছুদিন ঢাকায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে থাকবেন বলে জানিয়েছে দলীয় একটি সূত্র।
আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী দুই কন্যার মা। দলীয় রাজনীতিতে কখনও সরাসরি যুক্ত হননি। তবে কোকোর মৃত্যুর পর খালেদা জিয়ার যত্নে তার অনুপম উপস্থিতি এবং পারিবারিক নির্ভরতার প্রতীক হয়ে ওঠার বিষয়টি এখন রাজনৈতিক মূল্য পাচ্ছে। তিনি দলের নেতৃত্বে আসবেন কি না, তা অনিশ্চিত। কিন্তু তার প্রতি নেত্রীর নির্ভরতাই তাকে রাজনৈতিক গুরুত্ব এনে দিচ্ছে। সৈয়দা শার্মিলা রহমান সব সময় পর্দার আড়ালে থাকতেই পছন্দ করেছেন। রাজনীতির মাঠে তাকে দেখা যায়নি বললেই চলে। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার রাজনীতিতে আসা নিয়েও চলছে জোর চর্চা। নেতৃত্বে তার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ না থাকলেও পারিবারিক ঐতিহ্যের নিঃশব্দ উত্তরাধিকার তিনি বয়ে চলেছেন। বিএনপির অভ্যন্তরে একটি অংশ মনে করে, সৈয়দা শার্মিলা রহমানের এই ত্যাগ ও বিশ্বাসযোগ্যতা তাকে ভবিষ্যতে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে।
তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে খালেদা জিয়া আত্মপ্রকাশ করেন। সেদিন তিনি বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ লাভ করেন। একই বছর ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে খালেদা জিয়া প্রথম বক্তব্য রাখেন। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হন এবং এপ্রিল মাসের প্রথমে বিএনপির এক বর্ধিত সভায় তিনি ভাষণ দেন। সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের কয়েক মাস পরেই খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। এসময় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। এরপর ১৯৮৪ সালের ১০ মে খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮০ দশকে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে দেশজুড়ে খালেদা জিয়ার ব্যাপক পরিচিত গড়ে ওঠে। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে বিএনপি জয়লাভ করে। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক জীবনে যতগুলো নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তার সবগুলোতেই জয়লাভ করেছেন। ২০০১ সালে ক্ষমতাসীন হবার পর থেকে খালেদা জিয়ার সরকার একের পর এক বিতর্কের মুখে পড়ে। সেই বিতর্ক থেকে তার দল ও সরকার আর বেরিয়ে আসতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ঘটে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার দল বিএনপির ব্যাপক ভরাডুবি হয়। এরপর থেকে দলটি রাজনৈতিকভাবে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি রাজনৈতিকভাবে অনেকটা চাপে পড়ে যায়। খালেদা জিয়ার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হয় তার বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির মামলা। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালে কারাগারে যান সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হবার কারণে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে খালেদা জিয়া অংশ নিতে পারেননি। দেশে-বিদেশে সে নির্বাচন প্রবল বিতর্কের মুখে পড়ে। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে বেগম জিয়া সরকারের নির্বাহী আদেশে কারাগারের বাইরে ছিলেন। যদিও এজন্য তাকে নানা বিধিনিষেধ পালন করতে হয়। যার মধ্যে ছিল- রাজনীতিতে অংশ না নিতে পারা, কোনো ভাষণ বা বক্তব্য না দেয়া, বিদেশ যেতে না পারা ইত্যাদি। গত ৫ আগস্ট হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান খালেদা জিয়া। টানা ১৭ দিন চিকিৎসা শেষে ২৫ জানুয়ারি তাকে তার ছেলে তারেক রহমানের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে আজ মঙ্গলবার দেশে ফিরছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক সিনিয়র নেতা বলেন, ম্যাডাম দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী। তার অনুপস্থিতিতে রাজনীতিতে এক শূন্যতা বিরাজ করেছিল। এবার দেশে ফিরে ম্যাডাম আবার রাজনীতিতে ফিরে সেই শূন্যতা দূর করবেন বলে আশা করছি। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখনও দলের চেয়ারপারসন। তাকে দীর্ঘদিন কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল। তিনি নানা জটিল রোগেও ভুগছিলেন। লন্ডনে চিকিৎসা শেষে তিনি দেশে ফিরছেন। ম্যাডাম রাজনীতিতে সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি কখনও নির্বাচনে পরাজিত হননি। দেশে ফেরার পর বোঝা যাবে, তিনি রাজনীতিতে কতটা সক্রিয় হতে পারবেন।