নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল শুক্রবার ভোর পৌনে ৬টার দিকে জেলা শহরের দেওভোগ এলাকায় তার নিজ বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় সেখানে তার বিপুলসংখ্যক সমর্থক অবস্থান করছিলেন। গাড়িবহর নিয়ে পুলিশও ছিল সতর্ক অবস্থানে।
পরে তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় শহরের বিবি রোডের কালির বাজার মোড়ে ৩০-৪০ জনের একটি দল হামলা চালায়। তারা র্যাব ও পুলিশের গাড়ির দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে একটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ সময় পুলিশ দ্রুত বেগে গাড়ি চালিয়ে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আইভীকে নিয়ে যায়। এতে পুলিশের দুই সদস্যসহ পাঁচজন আহত হয়েছেন। তাৎক্ষণিকভাবে আহত ব্যক্তিদের নাম ও পরিচয় পাওয়া যায়নি। পরে হামলাকারীদের দলটি পরে শহরে ঝটিকা মিছিল করেন এবং আওয়ামী লীগ ও আইভীর বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। এরপর সকাল ১০টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে পোশাক শ্রমিক মিনারুল হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মাঈনুদ্দিন কাদিরের আদালতে তোলা হলে বিচারক ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন এবং আগামী ২৬ মে মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন। পরে তাকে ঢাকার কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।
দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারের জেল সুপার মোহাম্মদ ফোরকান ওয়াহিদ এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকে ঢাকার কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তিনি সেখানে কারা তত্ত্বাবধানে থাকবেন। নারায়ণগঞ্জ আদালত পুলিশের পরিদর্শক কাইউম খান বলেন, তার বিরুদ্ধে কোনো রিমান্ড আবেদন করেনি পুলিশ। জামিনও চাওয়া হয়নি।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে আইভীকে গ্রেপ্তারের জন্য তার বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। এ খবর শুনে চারদিক থেকে হাজার হাজার এলাকাবাসী তার বাড়ির সামনে এসে জড়ো হয়। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়রসহ সভাপতি ডা. সেলিনা হায়াত আইভী বলেছেন, আমি জেলে থেকেও নির্বাচন করব। আমি চুনকার মেয়ে। গত বৃহস্পতিবার দিনগত রাতে তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে গেলে তিনি নেতাকর্মীদের এ কথা বলে তার এ বার্তা সকলকে পৌঁছে দিতে বলেন। আইভী বলেন, আমি ভয় পাই না। আমি জেলে থেকেও নির্বাচন করব। আমি চুনকার মেয়ে। আমি সকালে যাব।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে পুলিশের একটি দল শহরের দেওভোগ এলাকায় অবস্থিত আইভীর বাড়ি চুনকা কুটিরে প্রবেশ করে। এসময় আইভীর গ্রেপ্তারের খবরে স্থানীয় বাসিন্দারা ও তার নেতাকর্মীরা রাস্তায় নেমে আসলে পুরো এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
এসময় আইভীর বাড়ির দিকে যাওয়ার চারটি রাস্তায় বাঁশ, ঠেলাগাড়ি, ভ্যানগাড়ি ফেলে সড়ক অবরোধ করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও আইভীর সমর্থকরা। আশপাশের এলাকার মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে সবাইকে আইভীর বাড়ির দিকে রওনা দেওয়ার আহ্বান জানান তারা। রাতভর আইভীর বাড়ি ঘিরে রাখেন নেতাকর্মীরা। আইভীর গ্রেপ্তার ঠেকাতে দেওভোগের স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি আশপাশে এলাকা থেকেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দেওভোগে এসে জড়ো হন।
এসময় নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে আইভী বলেন, তাদের (পুলিশ) বলবা আমি দিনের বেলা ছাড়া যাবো না। আমাকে আটক করতে হলে দিনের বেলা আসতে হবে। দিনের বেলা আমাকে নিতে হবে। এদিকে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলার ফলে বাড়ির ভেতরেই গ্রেপ্তার করতে আসা পুলিশের দলটি আটকা পড়ে। রাত ১২টার দিকে পুলিশের অতিরিক্ত ফোর্স আসে ঘটনাস্থলে। রাতভর আইভীর কর্মী সমর্থকদের সঙ্গে আলোচনার পর ভোরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আইভীর বাড়িতে প্রবেশ করেন। পরে ভোর রাতে আইভীকে গ্রেপ্তার করা হয়। নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসির উদ্দিন জানান, তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আইভি আরও বলেন, আমি কী জুলুমবাজ, আমি কী হত্যা করেছি, আমি কী চাঁদাবাজি করেছি, আমার এমন কোন রেকর্ড আছে নারায়ণগঞ্জ শহরে কোন বিরোধী দলকে আঘাত করেছি, তাহলে কীসের জন্য কী কারণে, কোন ষড়যন্ত্রের কারণে কার স্বার্থে আমাকে গ্রেপ্তার করা হলো।
তিনি বলেন, আপনারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন, নতুন সরকার এসেছে। আমি কোনো অপরাধ করিনি তাহলে কেন আমাকে গ্রেপ্তার, জানতে চাই সরকারের কাছে।
জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু বলায় যদি আমার শাস্তি হয় তাহলে আমি তা মাথা পেতে নেব। আমি কোনো অন্যায় করিনি, চাঁদাবাজি করিনি, হত্যা করিনি। যখন নারায়ণগঞ্জের একটা মানুষও কথা বলত না প্রতিবাদ করত না, তখন ত্বকী হত্যার প্রতিবাদসহ সব প্রতিবাদ আমি করেছি। আমি আপনাদের সেবা দিয়েছি।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক-সার্কেল) মো. হাসানুজ্জামান বলেন, সেলিনা হায়াৎ আইভীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসার সময় পুলিশের গাড়িবহরে হামলা ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। আমরা বিস্ফোরণের শব্দও শুনেছি। এতে দুই পুলিশ সদস্যসহ কয়েকজন আহত হয়েছেন। তবে সেলিনা হায়াত আইভীর কোনো ক্ষতি হয়নি। তাকে সিদ্ধিরগঞ্জের মিনারুল হত্যা মামলায় আদালতে হাজির করে শুনানি শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।