যুদ্ধবিরতির দুই দিন পর নীরবতা ভাঙলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। গতকাল বৃহস্পতিবার সামাজিকমাধ্যম এক্সে পোস্ট করা এক বার্তায় সংঘাতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরান বিজয়ী হয়েছে বলে ঘোষণা করেন তিনি। পরে টেলিভিশনেও জাতির উদ্দেশে খামেনির ভিডিওবার্তা প্রচারিত হয়। পোস্টে খামেনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে প্রবেশ করেছে, কারণ তারা মনে করেছিল, যদি তা না হয়, তাহলে ইহুদিবাদী শাসন সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধ থেকে কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। ইরান বিজয়ী হয়ে উঠতে পেরেছে এবং আমেরিকার মুখে এক কঠিন থাপ্পড় দিয়েছে।’
পরে টেলিভিশনে প্রচারিত ভিডিও বার্তায় ইরানের এই সর্বোচ্চ নেতা বলেন, ‘আমি মিথ্যাচারী জায়নবাদী শাসনের ওপর বিজয়ের জন্য আমার অভিনন্দন জানাই। ইরানের আঘাতে জায়নবাদী শাসনব্যবস্থা কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘মার্কিন শাসনের ওপর আমাদের প্রিয় ইরানের বিজয়ের জন্য অভিনন্দন। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে বাঁচানোর চেষ্টায় যুদ্ধে প্রবেশ করেছিল, কিন্তু কিছুই অর্জন করতে পারেনি।’
জাতির উদ্দেশে ভাষণে খামেনি বলেন, ‘ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখে একটি কঠিন চপেটাঘাত করেছে। ইরান আল-উদেইদ বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ করেছে এবং ক্ষতি সাধন করেছে, যা এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি।’ সর্বোচ্চ নেতা আরও উল্লেখ করেন, ‘ইরানের পক্ষে এই অঞ্চলের মার্কিন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে প্রবেশাধিকার থাকা এবং যখনই প্রয়োজন মনে করবে তখনই পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ধরনের পদক্ষেপ ভবিষ্যতেও পুনরাবৃত্তি হতে পারে। যদি কোনো আগ্রাসন সংঘটিত হয়, তবে শত্রুপক্ষকে অবশ্যই ভারী মূল্য দিতে হবে।’
ইসরায়েলের অর্থনীতি ও কৌশলগত খাতে বিপর্যয় : গাজা যুদ্ধ এবং বিশেষত ইরানের ‘ট্রু প্রমিজ-৩’ অভিযান ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সাতটি কৌশলগত কোম্পানি ও অর্থনৈতিক খাত এই যুদ্ধের ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আলজাজিরার বরাত দিয়ে পার্সটুডে জানিয়েছে, ইসরাইল শুধু সামরিক সংকটই নয়, তার ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন অর্থনৈতিক সংকটও পার করছে। ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েলি কোম্পানি ও বৃহৎ অর্থনৈতিক খাতগুলো ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এরমধ্যে রয়েছে- কার্যক্রম স্থগিত, বিদেশি বিনিয়োগের পতন, শেয়ারের মূল্য হ্রাস এবং পর্যটন, প্রযুক্তি ও জ্বালানির মতো কৌশলগত খাতগুলোর অচলাবস্থা। ইরানের মেহর নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, আল জাজিরা তার প্রতিবেদনে ইসরায়েলের সাতটি কোম্পানি ও অর্থনৈতিক খাতের ক্ষয়ক্ষতি বিশ্লেষণ করেছে, যার বেশিরভাগই ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ফলে হয়েছে।
বাজান পেট্রোকেমিক্যাল কোম্পানি : বাজান গ্রুপ ইসরায়েলের বৃহত্তম তেল শোধনাগার কোম্পানি, যার সদর দপ্তর হাইফায় অবস্থিত। এটি ইসরায়েলের তেল শোধন ও পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের মূল স্তম্ভ। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় এই কোম্পানির শোধনাগারগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, হামলায় তেল শোধনাগার কোম্পানিতে বিশাল বিস্ফোরণ ঘটেছে।
শেভরন কোম্পানি : শেভরন কোম্পানি ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত তামার ও লেভিয়াথান গ্যাসক্ষেত্র পরিচালনা করে। লেভিয়াথান ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় গ্যাস রপ্তানিকারক, যা দেশটির ৪০ শতাংশ গ্যাস উৎপাদন করে। ইরানের ‘ট্রু প্রমিজ-৩’ অপারেশনে লেভিয়াথান গ্যাসক্ষেত্র ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসরায়েলের জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও ব্লুমবার্গ নিউজ এজেন্সি এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
ইন্টেল (ক্রিয়াত গাট) : ইসরায়েলের ক্রিয়াত গাটে অবস্থিত ইন্টেলের কারখানায় হাজারো কর্মী নিয়োজিত। গাজা যুদ্ধের সময় এই কোম্পানি তার ১৫ শতাংশ কর্মী হারিয়েছে, যারা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর রিজার্ভ সদস্য ছিল এবং যুদ্ধে যোগ দেয়।
এল আল এয়ারলাইন্স : ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি হামলার পর, এল আল এয়ারলাইন্সের সব ফ্লাইট বাতিল করা হয় এবং বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে কোম্পানির শেয়ারের মূল্য ৩.৫ শতাংশ কমে যায়।
বেজেক গ্রুপ : এই গ্রুপ ইসরায়েলের বৃহত্তম টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি, যা সম্পূর্ণ যোগাযোগ সেবা প্রদান করে। গাজা যুদ্ধে এই কোম্পানির ২০২৪ সালে ১৪.৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এটি বারবার সাইবার হামলার শিকার হয়েছে। ২০২৩ সালে ইসরায়েলি স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ৩,৩৮০টি সাইবার হামলা হয়েছে, যা ইসরাইলকে ৩.২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির মুখে ফেলেছে।
উদীয়মান প্রযুক্তি খাত : গাজা যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ হ্রাসের কারণে ইসরায়েলের উদীয়মান প্রযুক্তি খাত গত বছর নজিরবিহীন সংকটে পড়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে, যার ফলে অনেক কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে বা তাদের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে। যেমন: স্পাইক কোম্পানি (কৃষি প্রযুক্তি খাতে সক্রিয়) ৫ মিলিয়ন ডলার তহবিল শেষ করে আরও ৪ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হওয়ায় বন্ধ হয়ে যায়। জিস্ট এমডি ৬.৫ মিলিয়ন ডলার তহবিল পেয়েও বাজার ও বিনিয়োগের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। পর্যটন খাত : অক্টোবর ২০২৩ থেকে গাজা যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েলের পর্যটন খাতের আয় ৯০ শতাংশ কমে গেছে এবং ৩.৪ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে। ইসরায়েলের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধের পর থেকে ইসরায়েলে পর্যটকের সংখ্যা ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে।
বিমান চলাচল বন্ধ এবং অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা পর্যটন খাতের পতনের মূল কারণ। ইসরায়েলি হোটেল মালিকদের মতে, কিছু এলাকায় হোটেলের অকুপেন্সি মাত্র ১০ শতাংশে নেমে এসেছে, যেখানে আগে এটি ৮০ শতাংশ ছিল। ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েলের আকাশসীমা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় এবং হাজারো ইসরায়েলি নাগরিক সাইপ্রাসের উদ্দেশ্যে নৌকায় করে পালিয়ে যায়।
নেতানিয়াহুর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নিঃশর্ত সমর্থন বন্ধ করা উচিত- স্যান্ডার্স : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্মন্টের স্বতন্ত্র সিনেটর এক বিবৃতিতে ইহুদিবাদী ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নিঃশর্ত সমর্থন বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। পার্সটুডে ইরনার বরাত দিয়ে আরও জানিয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্মন্টের সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স বুধবার গার্ডিয়ান সংবাদপত্রের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জোর দিয়ে বলেছেন : এখন সময় এসেছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর চরমপন্থি মন্ত্রিসভার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নিঃশর্ত সমর্থন বন্ধ করার, যারা গাজার জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাচ্ছে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের অনাহারে মারছে। তিনি এর আগে এক বিবৃতিতে জোর দিয়ে বলেছিলেন, ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অনাহারে ‘দুর্ভিক্ষ যুদ্ধে’র প্রতি ওয়াশিংটনের সমর্থন একটি ভয়াবহ বিষয়। মার্কিন এই সিনেটর আরও বলেন, ইসরায়েলকে সব ধরনের মার্কিন সামরিক সহায়তা বন্ধ করা জরুরি। দখলদার ইসরায়েলের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক বিষয়ে সিনেটের শুনানিতে স্যান্ডার্স এর আগে বলেছিলেন, ‘গাজায় যে সমস্ত মৃত্যু এবং দুর্ভোগ ঘটছে তাতে আমরা অংশীদার।’
জনগণের দৃঢ়তার ফলে জয় অর্জিত হয়েছে- ইরানি প্রেসিডেন্ট : ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, ইহুদিবাদী শাসকের (ইসরায়েল) বিরুদ্ধে জয় জনগণের দৃঢ়তা এবং প্রতিরোধের ফলে অর্জিত হয়েছে। জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক বার্তায় পেজেশকিয়ান এ কথা বলেন। খবর মেহের নিউজ এজেন্সির।
প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান বলেন, ‘ইসরায়েলি সরকারের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়েছে ইরানের মহান জাতির প্রতিরোধ, ঐক্য এবং সৌহার্দ্যের মাধ্যমে।’ তিনি বলেন, ‘এই সময়ে জাতির মধ্যে ঐক্য, শান্তি এবং সংহতি ফলপ্রসূ হয়েছে। এই ঐতিহাসিক বিজয়ের সমস্ত গৌরব মহান জাতি এবং সভ্যতার।’ তিনি আরও বলেন, ‘শত্রু যদি ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পরিচয়ের প্রতি গভীর মনোযোগ দিত, তাহলে তারা কখনও এই গুরুতর ভুল করত না।’ ইরানিদের সাহসী প্রতিরোধের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, তারা ইহুদিবাদী শাসকের ১২ দিনের যুদ্ধের অবসান প্রত্যক্ষ করছে। তিনি বলেন, শত্রুরা কিছু অজুহাতে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের ওপর আগ্রাসন চাপিয়ে দিয়েছে। একইসঙ্গে ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচিতে যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি নিরনের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। গত ১৩ জুন ইরানে ব্যাপক আগ্রাসন শুরু করে ইসরায়েলি সরকার। হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কমান্ডার এবং পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের হত্যা করে দখলদার বাহিনী। এছাড়া বিভিন্ন প্রদেশের পারমাণবিক, সামরিক এবং বেসামরিক অবকাঠামো এবং আবাসিক ভবনগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করে বোমা হামলা চালায়।
ইসরায়েলি হামলার জবাবে তেলআবিবে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনী। দুদেশের মধ্যে হামলা-পালটা হামলার মধ্যেই গত রোববার ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রতিক্রিয়ায় সোমবার রাতে কাতারের দোহায় মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। এরপরই যুদ্ধবিরতির কথা বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মঙ্গলবার ভোরে তিনি ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির কথা জানান।
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাখ্যাকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের হত্যা’ বলল ইরান : জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থাপিত ব্যাখার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইরান। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সেক্রেটারি জেনারেল ও প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি আমির সাঈদ ইরাভানি এই ব্যাখ্যাকে ‘আইনিভাবে ভিত্তিহীন’ বলে অভিহিত করেছেন। চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলাকে ‘অবৈধ এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন’ বলে উল্লেখ করেছে ইরান। একইসাথে জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদের আওতায় আত্মরক্ষার অধিকার দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের হত্যা’ বলে অভিহিত করা হয়।
চিঠিতে ইরাভানি আরও উল্লেখ করেন, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সাধারণ সম্মেলনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, ‘শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর যেকোনো ধরনের হামলা কিংবা হামলার হুমকি আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন এবং সংস্থাটির বিশ্বাসযোগ্যতা ও যাচাই প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ণ করে।’ এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান কাযা কাল্লাসও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘যে কেউ বলপ্রয়োগ করলে তাকে আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে ন্যায়সঙ্গতভাবে তা ব্যাখ্যা করতে হবে’। হামলাটি আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে কতটা বৈধ- এই প্রশ্নের জবাবে কায়া কাল্লাস বলেন, ‘শতভাগ বৈধ বলা যায় না।
ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির পর চীন সফরে ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী : ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির পর ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আজিজ নাসিরজাদেহ তার প্রথম বিদেশ সফরে চীনে পৌঁছেছেন। এই সফরে তিনি পূর্ব চীনের সমুদ্র উপকূলবর্তী শহর ছিংদাও-তে অনুষ্ঠিত শাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও) সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন। এই বৈঠক বুধবার ও বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যার আয়োজক চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী দং জুন। গতকাল বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়েছে সিএনএ। বুধবার সম্মেলনের ফাঁকে নাসিরজাদেহের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছেন চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী। রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম শিনহুয়ার বরাত দিয়ে জানানো হয়, দং জুন এই বৈঠকে সমস্ত পক্ষকে পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করে বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা রক্ষার আহ্বান জানান।
২০২৩ সালে ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে এসসিও-তে যোগ দেয়। চীন-নেতৃত্বাধীন এই নিরাপত্তা জোটে আরও সদস্য দেশ হলো: রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও বেলারুশ। মধ্যপ্রাচ্যের উত্তাল পরিস্থিতি ও ইউরোপে ন্যাটো সদস্যদের সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির ঘোষণার পটভূমিতে বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) ছিংদাও শহরে চীন ইরান ও রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের নিয়ে এই সম্মেলন আয়োজন করে। চীন বহুদিন ধরেই এসসিও-কে পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন শক্তি বলয়ের পাল্টা এক বিকল্প প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তুলে ধরতে চাচ্ছে এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রাজনীতি, নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা জোরদারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে।
এই সম্মেলন এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ১২ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর এক নাজুক যুদ্ধবিরতি কার্যকর রয়েছে। সম্মেলনের ঠিক আগের দিনই নেদারল্যান্ডসের হেগে ন্যাটো নেতাদের এক শীর্ষ বৈঠকে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির ঘোষণা আসে, যা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণের অংশ। চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী দং জুন বলেন, ‘যখন শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলো দ্রুত ঘটছে, তখন একতরফা নীতি ও সুরক্ষাবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আধিপত্যবাদ, দমিনিরিং আচরণ ও অন্যদের শাসন করার প্রবণতা আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলাকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’ তিনি বিভিন্ন দেশের প্রতিরক্ষা প্রধানদের আহ্বান জানান, ‘একসঙ্গে আরো জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করে শান্তিপূর্ণ উন্নয়নের পরিবেশ রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে।’ ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংও ছিংদাও সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘এসসিও সদস্যদের উচিত একত্রে কাজ করে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ ও আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ব আজ এক বিশাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যেই বিশ্বায়ন একসময় আমাদের কাছাকাছি এনেছিল, আজ তা ধীরে ধীরে গতি হারাচ্ছে।’
সম্মেলনের ফাঁকে রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রেই বেলোউসোভের সঙ্গে বৈঠকে চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী দং জুন বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক এখন ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।’ রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের মৈত্রীর সম্পর্ক সমস্ত ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বমুখী গতিতে এগোচ্ছে।’ উল্লেখ্য, চীন নিজেকে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রশ্নে নিরপেক্ষ পক্ষ হিসেবে তুলে ধরলেও পশ্চিমা দেশগুলো মনে করে, বেইজিংয়ের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক মস্কোকে কার্যত সমর্থন জোগাচ্ছে।
ইরানের ওপর তেল নিষেধাজ্ঞা শিথিলের ইঙ্গিত ট্রাম্পের : ইরানের ওপর থেকে তেল নিষেধাজ্ঞা শিথিলের ইঙ্গিত দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের পর দেশটির পুনর্গঠনে সাহায্য করতে এমন পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনও ইরানের ওপর ‘সর্বোচ্চ চাপ’ প্রয়োগের কৌশল বজায় রেখেছে, যার মধ্যে রয়েছে দেশটির তেল বিক্রির ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে।
তবে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, ইরানকে নিজেদের দেশ পুনর্গঠনে সাহায্য করতে এই নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগে কিছুটা নমনীয়তা আনা হতে পারে। ন্যাটো সম্মেলনে এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, ‘ওদের দেশ আবার গড়ে তুলতে অর্থ লাগবে। আমরা চাই সেটা হোক।’
এর আগের দিন তিনি বলেছিলেন, ইসরায়েল ও ইরানের যুদ্ধবিরতির পর চীন চাইলে ইরানের কাছ থেকে তেল কিনতে পারবে। তবে পরে হোয়াইট হাউস স্পষ্ট করে জানায়, প্রেসিডেন্টের ওই মন্তব্যের অর্থ এই নয় যে যুক্তরাষ্ট্র ওই নিষেধাজ্ঞা শিথিল করছে।
প্রসঙ্গত, ‘টিপট’ রিফাইনারিসহ চীনের বেশ কয়েকটি স্বাধীন তেল শোধনাগার ও বন্দরের টার্মিনাল অপারেটরদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র একাধিকবার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, যারা ইরানের কাছ থেকে তেল কিনছিল। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি-কে বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ওই মন্তব্য চীনের প্রতি একটি বার্তা- ‘আমরা তোমাদের সঙ্গে কাজ করতে চাই, তোমাদের অর্থনীতিকে ক্ষতি করতে চাই না।’
উল্লেখ্য, চীন ইরানের শীর্ষ তেল ক্রেতা এবং দেশটি ট্রাম্প প্রশাসনের ইরানবিরোধী নিষেধাজ্ঞার শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছে। উইটকফ বলেন, ‘আমরা চাই একসঙ্গে কাজ করতে এবং আশা করি, এটা ইরানিদের জন্যও একটা বার্তা হবে।’
ইরান-ইসরায়েল ‘ক্লান্ত’, ফের শুরু হতে পারে সংঘাত, বললেন ট্রাম্প : টানা ১০ দিন সংঘাতের পর যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে ইরান এবং ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে গেলেও তারা ‘সত্যিকার অর্থে’ বিরতিতে যায়নি বলে মনে করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ‘শিগগিরই কোনো দিন’ তারা ফের সংঘাতে মেতে উঠতে পারে বলে উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন তিনি।
ন্যাটোর সম্মেলন উপলক্ষে বুধবার নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে ছিলেন ট্রাম্প। সেখানে সম্মেলনের অবসরে সাংবাদিকদের সঙ্গে মত বিনিময়কালে ইরান-ইসরায়েলের সাম্প্রতিক সংঘাত প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা অনেকেই ভাবছি এটা শেষ হয়ে গেছে; কিন্তু আমার মনে হয় না ইরান এবং ইসরায়েল সত্যিকার অর্থেই বিরতি মেনে নিয়েছে। আমার ধারণা, একটানা কঠিন এবং ভয়াবহ সংঘাতে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, তাই বিশ্রাম নিচ্ছে।’ ‘আবার কি সংঘাত শুরু হতে পারে? আমার মনে হয় কোনো দিন এটা শুরু হতে পারে এবং সেই দিন হয়তো শিগগিরই আসবে।’
উল্লেখ্য, ইরান পরমাণু বোমা তৈরির দোরগোড়ায়- অভিযোগ তুলে গত ১৩ জুন রাজধানী তেহরান ও অন্যান্য এলাকায় বিমান অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী। এই অভিযানের জবাবে ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা শুরু করে ইরানও। ইরান-ইসরায়েলের এ সংঘাত শুরুর ১০ দিন পর ২২ জুন মধ্যরাতে ইসরায়েলের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালায় মার্কিন বিমান বাহিনী। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সামরিক কমান্ড এ অভিযানের নাম দিয়েছিল ‘দ্য মিডনাইট হ্যামার’।
‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ পরিচালনার একদিন পর ইরান-ইসরায়েলে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
সেই সঙ্গে তিনি দাবি করেন, ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ অভিযানে ইরানের পরমাণু সক্ষমতার মূলে আঘাত হানা হয়েছে এবং দেশটির আর কখনও পরমাণু প্রকল্প পুনরুজ্জীবিত করতে পারবে না। হেগ শহরে সাংবাদিকদের সঙ্গে মত বিনিময়কালে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত থামানোর কৃতিত্ব যুক্তরাষ্ট্রের বলে দাবি করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, ‘এ সংঘাতে তখনই বিরতির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে- যখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশ করেছে। যখন আমাদের যুদ্ধবিমান ইরানের একাধিক পরমাণু স্থাপনায় আঘাত হেনেছে- তখনই আসলে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে।’