ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

পেটের এক দিক দিয়ে গুলি ঢুকে আরেক দিকে বেরিয়ে যায়

পেটের এক দিক দিয়ে গুলি ঢুকে আরেক দিকে বেরিয়ে যায়

২০ জুলাই দুপুরবেলা রাজধানীর চিটাগাং রোড এলাকায় গোলাগুলি ও সংঘর্ষ চলছিল। পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলছিল পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ ও ককটেল বিস্ফোরণ চলছে। দুপুরে ভাত খেয়ে বাসা থেকে বের হয় ছোট্ট হোসেন মিয়া (১০)। পপকর্ন, আইসক্রিম ও চকলেট ফেরি করে সে। বিকেল সাড়ে পাঁচটার পর থেকে খোঁজ নেই হোসেনের। বাবা মানিক মিয়া সন্তানের খোঁজে বের হন। কোথাও নেই। সংঘর্ষের কারণে অন্তত দুই ঘণ্টার উল্টো পথে এসে দেখেন, তার ছেলে এখনো বাসায় ফেরেনি। বাসায় ছোট্ট দুই মেয়েকে তালাবন্দি করে মানিক মিয়া স্ত্রী মালেকা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে সন্তানের খোঁজে বের হন। চিটাগাং রোডসহ আশপাশের এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও হদিস মেলেনি হোসেনের। এরপর রাত ৯টার দিকে কেউ একজন এসে মুঠোফোনে হোসেনের ছবি দেখান। মানিক ও মালেকা সন্তানের আহত অবস্থার ছবি দেখে চিনতে পারেন। তারা জানতে পারেন, হোসেনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর দেরি না করে স্বামী-স্ত্রী একটি পিকআপে করে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত যান। সেখান গিয়ে আরও বিপদ। সড়কে কোনো গাড়ি নেই। কিছু সময় হেঁটে, কিছু সময় জিরিয়ে নিয়ে এগিয়ে চলেন। পথে পথে সংঘর্ষ। পরে এক রিকশাওয়ালাকে হাতে-পায়ে ধরে রাত সাড়ে ১২টায় ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছান। ঢাকা মেডিকেলের সব জায়গা খুঁজে হোসেনকে পেলেন না। চিকিৎসকদের কাছে গেলে তারা বলেন, চিটাগাং রোড এলাকা থেকে গুলিবিদ্ধ অনেককেই আনা হয়েছে। আহত সবার চিকিৎসা চলছে।

দিবাগত রাত দুইটা পর্যন্ত চিকিৎসা চলছে ভেবে স্বামী-স্ত্রী বসে ছিলেন। এ সময় একজন এসে জিজ্ঞাসা করেন, তারা কেন এখানে বসে আছেন? পরে নিজের সন্তানের কথা বলেন। এ সময় লোকটা তাদের লাশঘরের কাছে নিয়ে যান। অনেকগুলো লাশের সঙ্গে ছোট্ট হোসেনের লাশ দেখে বাবা মানিক মিয়া জ্ঞান হারান। মা মালেকা বেগমের চিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে ঢাকা মেডিকেলের পরিবেশ।

গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার পর হোসেনের লাশ ২২ জুলাই রাত দুইটার দিকে নানাবাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বারের রাজামেহার ইউনিয়নের বেতরা গ্রামে দাফন করা হয়। নিহত হোসেনের মামা মোস্তফা কামাল বলেন, ‘হোসেনদের পরিবার ঢাকায় থাকলেও তারার তেমন কিছু নাই। বাপ-পুতে ফেরি কইয়া যা পায়, তা দিয়ে তারার সংসারডা চলত। যহন হুনলাম হোসেনের লাশ লইয়া আইতাছে, আমডা কয়েকজন মিল্যা কাফনের কাফড় কিনছি। দোকান বন্ধ আছিল। দোকানদাররে বাইত (বাড়ি) যাইয়া অনুরোধ করছি। তারপর কাফনের কাফড় আরও কিছু লইয়া আইছি। কেউ বাঁশ কাটছে, কেউ কবর খুঁড়ছে। সোমবার রাইত ২টার দিকে জানাজা দিয়া এরপর তারে কবর দিছি। পোলাডারে হারাইয়া বাপডা প্রতিদিন একবার বেহুঁশ হয়।’

২৬ জুলাই সকালে দেবীদ্বারের বেতারা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের দরজায় বসে আছেন মানিক মিয়া ও মালেকা বেগম। প্রতিবেশী ও স্বজনদের কোনো সান্ত¡না-প্রবোধ মানছেন না। কিছুক্ষণ পরপর ছেলের ছবি দেখে ডুকরে কাঁদছেন তারা। সন্তানহারা মা-বাবার আর্তনাদে প্রতিবেশীরাও চোখ মোছেন।

মানিক মিয়া বলেন, তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার বরশাল গ্রামে। সেখানে তার স্বজন বলতে কেউ নেই। বিয়ের পর থেকে তিনি শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। বছর পাঁচেক আগে ঢাকায় যান। চিটাগাং রোড মুক্তিনগর এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। ঢাকায় সারা দিন ফেরি করেন। চিপস, চকলেট, আইসক্রিম বিক্রি করেন। নিহত ১০ বছর বয়সী হোসেন তার বড় ছেলে। সেও ফেরি করত। মানিক-মালেকা দম্পতির মাহিনুর আক্তার (৮) ও শাহিনুর আক্তার (৬) নামের দুই মেয়ে আছে।

মানিক মিয়া বলেন, ‘হাসপাতালে পোলার লাশ দেহনের পর আমার আর বাইচ্চা থাহনের ইচ্ছা অয় না। আমার এইটুকু একটা পোলা। তার শইলে দুইডা গুলি লাগছে। একটা গুলি তার তলপেট দিয়া ডুইক্কা আরেক দিক দিয়া বাইর অইচে, আরেকটা তার কোমরে ডুইক্কা গেছে। আমার পোলাডা কত কষ্ট না জানি পাইছে। আল্লাহ আমার পোলাডারে কেন লইয়া গেলা।’

ছেলের ছবি দেখে চিৎকার করে ছেলেকে ডাকেন মা মালেকা বেগম। মালেকা বলেন, ‘হোসেন রে, একবার মা কইয়া ডাক দে, আমার কইলজা ঠান্ডা হইক।’ একটু শান্ত হয়ে মালেকা বেগম আবার বলেন, ‘হেদিন আমার শইলডা ভালো আছিলো না। পোলা কয়, পপকন-আইসক্রিম বেইচ্চা যেই টাকা পাইবো, এই টাকা দিয়া আমার চিকিৎসা করাইবো। আমার পোলা আর ফিরা আইলো না।’

মানিক মিয়া বলেন, ‘পোলাডা শনিবার বিকেলে মরল। এই লাশ আনতে গিয়ে আমডা কত বিপদে পড়ছি। এই অফিসে যাও, হেই অফিসে যাও। থানায় গিয়া জিডি করো। কত স্বাক্ষর দিছি। এরপর সোমবার পোলার লাশ পাইছি। এই লাশ লইয়া আইতে গিয়া আরও কত বিপদ। সোমবার রাইত দুইটার দিকে পোলার জানাজা হয়।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত