
ঢাকায় ফিরলেন জুলাই জজবার প্রাণ, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার অকুতোভয় বীর শহিদ শরীফ ওসমান হাদির মরদেহ। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৫টা ৪৮ মিনিটে তার মরদেহ বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটি (ইএ-৫৮৫) ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানবন্দরের ক্যান্টনমেন্ট গেট দিয়ে থেকে বের হয় হাদির মরদেহ। এর আগে বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টা ৩ মিনিটে সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইটটি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এরপর থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরের ৮ নম্বর ফটকের সামনে ভিড় করেন হাদির অনুসারীরা। হাদির মরদেহ সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকায় আনাকে কেন্দ্র করে শাহজালাল বিমানবন্দরে কড়া নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এদিকে, শরীফ ওসমান হাদির কফিন ধরে কাঁদতে দেখা গেছে দেশের জাতীয় নেতাদের। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। হাদির কফিন ধরে কাঁদতে দেখা যায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি আবু সাদিক কায়েমসহ অন্যান্য নেতাদের। এ সময় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জেনারেল সেক্রেটারি মিয়া গোলাম পরওয়ার, সরকারের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেনকে বিমর্ষ দেখা যায়।
মরদেহ হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের হিমঘরে : ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির মরদেহ গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের হিমঘরে নেওয়া হয়। দেশে পৌঁছানোর সময় বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিল। বিমানবন্দরের বাইরে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ও সেনা সদস্যরা মোতায়েন ছিলেন। মরদেহ বিমানবন্দর ৮ নং গেইট থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে-ফার্মগেট-মানিকমিয়া এভিনিউ হয়ে হিমঘরে নেয়া হয়। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায়ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকা, কারওয়ান বাজার, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, যমুনাসহ আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দায়িত্ব পালন করে।
এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক আজ : শরীফ ওসমান বিন হাদির মৃত্যুতে আজ শনিবার রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে সরকার। গত বৃহস্পতিবার রাতে সিঙ্গাপুরে হাদির মৃত্যুর খবর আসার পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এ ঘোষণা দেন। প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা দেন, শহীদ ওসমান হাদির স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানের দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করবে। শহীদ শরীফ ওসমান হাদির অকাল মৃত্যুতে আগামী শনিবার একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করছি। এ উপলক্ষে শনিবার (আজ) দেশের সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে।
কবি নজরুলের পাশে সমাহিত হবেন শহীদ ওসমান হাদি : পরিবারের দাবির ভিত্তিতে জুলাই জজবার প্রাণ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অকুতোভয় বীর শহীদ শরিফ ওসমান হাদিকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে সমাহিত করা হবে বলে জানিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে ইনকিলাব মঞ্চের ফেসবুক পেজে এ তথ্য জানানো হয়।
দুপুর ২টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জানাজা : আজ শনিবার দুপুর দুইটায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ওসমান হাদির নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। প্রেস উইংয়ের এক বার্তায় বলা হয়েছে, শহীদ ওসমান হাদির নামাজে জানাজায় অংশগ্রহণে আগ্রহীদের কোনো প্রকার ব্যাগ বা ভারী বস্তু বহন না করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, এসময় সংসদ ভবন ও এর আশপাশের এলাকায় ড্রোন উড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
উল্লেখ্য, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার পরদিন রাজধানীর বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট রোড এলাকায় মোটরসাইকেলে আসা দুই সন্ত্রাসীর গুলিতে মারাত্মক আহত হন ওসমান হাদি। রিকশায় থাকা অবস্থায় তার মাথায় গুলি লাগে। প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, পরে অবস্থার অবনতি হলে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হলে, সেখানে গত বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুতে দেশে ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে।
এক নজরে ওসমান হাদি, যেভাবে রাজপথের বিপ্লবী হয়ে ওঠেন : শরীফ ওসমান হাদি ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের সব সময় ছিলেন প্রতিবাদ মুখর। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের তরুণ রাজনৈতিক কর্মী, বক্তা এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আত্মপ্রকাশ করা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম ইনকিলাব মঞ্চণ্ডএর মুখপাত্র। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি রাজপথ, ক্যাম্পাস ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসেন।
ওসমান হাদির জন্ম ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় এক ধর্মভীরু মুসলিম পরিবারে। তার বাবা ছিলেন একজন মাদ্রাসা শিক্ষক ও স্থানীয় ইমাম। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। শৈশব থেকেই পারিবারিক পরিবেশে ধর্মীয় শিক্ষা, শৃঙ্খলা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার চর্চা তার ব্যক্তিত্ব গঠনে ভূমিকা রাখে।
হাদির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু নলছিটির একটি মাদ্রাসায়। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সেখানে পড়াশোনার পর তিনি ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং আলিম পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি রাজধানী ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই তার রাজনৈতিক চিন্তা ও নেতৃত্বগুণ আরও বিকশিত হয়।
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল ওসমান হাদির রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘোরানো অধ্যায়। ওই সময় তিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন এবং ঢাকার রামপুরা এলাকায় সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। তরুণদের সংগঠিত করা, মিছিল-সমাবেশে বক্তব্য দেওয়া এবং রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি তুলে ধরার মাধ্যমে তিনি দ্রুত পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন।
জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার অভিজ্ঞতা ও দাবির ভিত্তিতে ওসমান হাদির নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ইনকিলাব মঞ্চ। সংগঠনটির ঘোষিত লক্ষ্য হলো—সব ধরনের আধিপত্যবাদ ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা এবং ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা। গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ, ন্যায়বিচার ও রাজনৈতিক জবাবদিহিকে এই প্ল্যাটফর্মের মূল ভিত্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়।
স্বল্প সময়ের রাজনৈতিক জীবনে ওসমান হাদি তরুণদের মধ্যে প্রতিবাদী রাজনীতির প্রতীক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।