
অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের সকল নাগরিককে কয়েকজন বিচ্ছিন্ন উগ্র গোষ্ঠীর দ্বারা সংঘটিত নব ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে দৃঢ় সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে। সরকার জানিয়েছে, সহিংসতা, ভীতি প্রদর্শন, অগ্নিসংযোগ ও জানমাল ধ্বংসের সকল কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তারা দৃঢ় ও দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দা প্রকাশ করে। শুক্রবার অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে জানানো হয়, ইতিহাসের এই সংকটময় সময়ে বাংলাদেশ একটি ঐতিহাসিক গণতান্ত্রিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। যারা বিশৃঙ্খলাকে পুঁজি হিসেবে নেয় এবং শান্তির পথ উপেক্ষা করে- এমন অল্প কয়েকজনের কারণে এই অগ্রযাত্রা কোনভাবেই ব্যাহত হতে দিতে পারি না এবং দেওয়া হবে না।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আসন্ন নির্বাচন ও গণভোট কেবল রাজনৈতিক অনুশীলন নয়; এগুলো একটি গুরুতর জাতীয় অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে সেই স্বপ্নের সঙ্গে, যার জন্য শহীদ শরিফ ওসমান হাদি তার জীবন উৎসর্গ করেছেন। হাদির আত্মত্যাগ ও স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে হলে সংযম, দায়িত্বশীলতা এবং ঘৃণা প্রত্যাখ্যানের প্রতি অবিচল অঙ্গীকার প্রয়োজন বলে সরকার উল্লেখ করেছে। সংবাদমাধ্যমের ওপর সাম্প্রতিক হামলার প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী বিবৃতিতে জানানো হয়, দ্য ডেইলি স্টার, প্রথম আলো ও নিউ এজ-এর সাংবাদিকদের পাশে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সাংবাদিকরা যে সন্ত্রাস ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন, তার জন্য গভীর দুঃখও প্রকাশ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, সন্ত্রাসের মুখেও সাংবাদিকদের সাহস ও সহনশীলতা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। সরকার স্পষ্ট করে জানিয়েছে, সাংবাদিকদের ওপর হামলা মানেই সত্যের ওপর হামলা এবং এ ঘটনায় পূর্ণ ন্যায়বিচার নিশ্চিতের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, ময়মনসিংহে এক হিন্দু ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় গভীর নিন্দা জানিয়ে সরকার বলেছে, নতুন বাংলাদেশে এ ধরনের সহিংসতার স্থান নেই। এই নৃশংস অপরাধের সঙ্গে জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। বিবৃতির শেষাংশে সংকটময় এই মুহূর্তে প্রত্যেক নাগরিকের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সরকার বলেছে, সহিংসতা, উসকানি ও ঘৃণাকে প্রত্যাখ্যান ও প্রতিরোধের মাধ্যমে শহীদ হাদির প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার সম্পাদকের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার ফোনালাপ : দৈনিক প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ে গত বৃহস্পতিবার রাতে হামলার ঘটনায় পত্রিকা দুটির সম্পাদকের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনাদের প্রতিষ্ঠান ও সংবাদকর্মীদের ওপর এই অনাকাঙ্ক্ষিত ও ন্যক্কারজনক হামলা আমাকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছে। এই দুঃসময়ে সরকার আপনাদের পাশে আছে।’ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় দুটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ওপর এই হামলা স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর হামলার শামিল। এই ঘটনা দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বিরাট বাধা সৃষ্টি করেছে। টেলিফোনে আলাপকালে সম্পাদকদের ও সংবাদমাধ্যমগুলোর পূর্ণ নিরাপত্তাসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন ড. ইউনূস। খুব শিগগিরই এই দুই সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে বলেও জানান প্রধান উপদেষ্টা।
দুই শীর্ষ গণমাধ্যমে হামলায় ‘লজ্জিত’ প্রেস সচিব : দৈনিক প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার ভবনে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে দুঃখপ্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, ‘সাবেক একজন সাংবাদিক হিসেবে শুধু এটুকুই বলতে পারি- আমি দুঃখিত।’ ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে অন্তর্বতী সরকারের প্রেস সচিব লেখেন, ‘গত রাতে ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর ভেতরে আটকে পড়া সাংবাদিক বন্ধুদের কাছ থেকে বারবার সাহায্যের জন্য ফোন পেয়েছি। তাদের অসহায় কণ্ঠ আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আমি সাহায্য জোগাড়ের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি- সংশ্লিষ্ট সবাইকে ফোন করেছি, সহায়তা পৌঁছাতে চেয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা সময়মতো সম্ভব হয়নি।’ তিনি আরও জানান, যখন তিনি নিশ্চিত হন যে ডেইলি স্টারের ভেতরে আটকে পড়া সব সাংবাদিককে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়েছে, তখন তিনি ঘুমাতে যান। তবে ততক্ষণে দেশের দুটি শীর্ষ সংবাদমাধ্যম ভয়াবহ সহিংসতা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয়েছে। এই ঘটনায় ‘লজ্জিত হয়েছেন’ জানিয়ে শফিকুল আলম বলেন, ‘আমি জানি না কোন ভাষায় এই ক্ষতির সান্ত¡না দেওয়া যায়। একজন সাবেক সাংবাদিক হিসেবে শুধু বলতে পারি- আমি লজ্জিত। মনে হচ্ছে, যদি পারতাম, লজ্জায় নিজেকে মাটির নিচে চাপা দিতাম।’
এই হামলা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আঘাত- এমএফসি : প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা-অগ্নিসংযোগের তীব্র নিন্দা জানিয়ে এ ঘটনার দ্রুত তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশন (এমএফসি)। শুক্রবার এক যৌথ বিবৃতিতে এ আহ্বান জানায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা এ জোটের সদস্য রাষ্ট্রগুলো। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গত রাতে সাংবাদিক, সম্পাদক ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশন (এমএফসি)। এ ধরনের সংঘাত ও ভীতি প্রদর্শন অগ্রহণযোগ্য এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও জনগণের তথ্য জানার অধিকারের উপর আঘাত।’
এমএফসি বলেছে, ‘সব গণমাধ্যমকর্মীর নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানাচ্ছি। সাংবাদিকদের ভয়হীন থেকে কাজ করার সুযোগ অবশ্যই থাকতে হবে। আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে এবং উন্মুক্ত ও তথ্য সমৃদ্ধ সমাজের জন্য তাদের সুরক্ষা অপরিহার্য।’
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী কাজ করা ৫১ দেশের জোট মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশন। ২০১৯ সালে কানাডায় প্রতিষ্ঠিত এই মোর্চার বর্তমান কো-চেয়ার জার্মানি এবং ফিনল্যান্ড। বাংলাদেশে দূতাবাস থাকা কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নরওয়ে, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাজ্য এই যৌথ বিবৃতি দিয়েছে।
এদিকে দুই সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে হামলার নিন্দা জানিয়েছে ‘প্রেস ক্লাব, কলকাতা’। শুক্রবার সংগঠনের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ঢাকায় একাধিক সংবাদ প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্রেস ক্লাব কলকাতা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে।’ বাংলাদেশের সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের সুরক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বানও জানোনো হয় বিবৃতিতে। প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার রাতে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে রাত ১২টার দিকে একদল জনতা প্রথমে দৈনিক প্রথম আলো, এরপর দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকা অফিসে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এতে সংবাদপত্র দুটির অনেক সাংবাদিক সেখানে আটকা পড়েন। এ খবরে সেখানে গিয়ে ভবনের সামনে বিক্ষোভকারীদের একটি অংশের বাধার মুখে পড়েন ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজের সম্পাদক নূরুল কবীর।