
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবরে গত বৃহস্পতিবার রাতে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। এদিন চট্টগ্রামের খুলশীতে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার ড. রাজীব রঞ্জনের কার্যালয়ে ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনাসহ সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের বাড়িতে মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। এছাড়া কুষ্টিয়ার প্রথম আলোর অফিসসহ আওয়ামী নেতাদের ঘরবাড়ি ও রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের অফিস ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। বিক্ষোভকারীরা সহকারী হাইকমিশনারের কার্যালয়ে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। এসময় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় পুলিশসহ ৩ জন আহত হন বলে জানা যায়। এ ঘটনায় সন্দেহভাজন ১০ জনকে আটক করেছে পুলিশ। এর আগে, ওসমান হাদির মৃত্যুর খবরে জেলার ষোলশহর এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে, ওসমান হাদি মৃত্যুর খবরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এ দিন রাজশাহীতে বুলডোজার চালিয়ে আওয়ামী লীগের অফিস ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। একই ঘটনায় বগুড়া-শেরপুর মহাসড়কেও বিক্ষোভ করে ছাত্র-জনতা। এতে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ঢাকার সড়কপথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে, দুই প্রান্তে সৃষ্টি হয় ব্যাপক যানজটের। এ দিন বান্দরবান শহরেও বিক্ষোভ মিছিল করেন বিক্ষুব্ধরা। এ বিক্ষোভ মিছিল থেকে সাবেক সংসদ সদস্য বীর বাহদুরের বাসার দিকে যান বিক্ষোভকারীরা। এসময় তার বাসায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনায় ছাত্র-জনতা ও পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় ৬ পুলিশসদস্যসহ আহত হন। গাজীপুরের টঙ্গীতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছে এনসিপি। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গাজীপুরের প্রথম আলো অফিস এবং পুলিশ লাইন্স ভেঙে দেয়ার হুমকি দেয়া হলে নিরাপত্তায় সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক অবস্থান দেখা যায়। কুষ্টিয়াতেও বিক্ষোভ মিছিল করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা। পরে টায়ার জ্বালিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা।
ঘণ্টাব্যাপী অবরোধ শেষে কর্মসূচি প্রত্যাহার করলে রাত ১২টায় যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়। এরপর গত বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার সময় প্রথম আলোর অফিসসহ শহরের বিভিন্ন এলাকার আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কবির হোসেন মাতুব্বর বলেন, ‘এমন বেশকিছু খবর শুনেছি। তবে এ বিষয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তাণ্ডবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে প্রথম আলো-ডেইলি স্টার ভবন : রাজধানীর কাওরান বাজারে অবস্থিত দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকার কার্যালয় ও প্রথম আলোর অফিসে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ একদল লোক। শুক্রবার প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, দমকলকর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষয়ক্ষতির পর্যালোচনার কাজ করছেন। ভবনের সামনে উৎসুক জনতার ভিড় জমেছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে পুলিশ সদস্যদেরও অবস্থান করতে দেখা গেছে। সরেজমিনে দেখা যায়, ডেইলি স্টার ভবনের ১ থেকে ৩তলা পর্যন্ত আগুনে পুড়ে গেছে। আগুনে এসব তলার অফিস কক্ষ, আসবাব ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে ৪ থেকে ৭তলা পর্যন্ত অফিসের প্রায় সব সামগ্রী লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়েছে। কাগজপত্র, কম্পিউটার, আসবাবসহ বিভিন্ন উপকরণ তছনছ করে ফেলা হয়েছে। এক কথায় পুরো ভবনই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সকালে ভবনের সামনে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীদের তথ্য সংগ্রহ ও ছবি তুলতে দেখা যায়। প্রিয় কর্মস্থলে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন ডেইলি স্টারের ফটো সাংবাদিক প্রবীর দাশ। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার সব স্মৃতি, আমার এত বছরের ক্যারিয়ারে তোলা ছবি— চার-পাঁচটি হার্ডড্রাইভ। অগ্নিসংযোগকারীরা হয়তো জানে না, একজন সাংবাদিকের কাছে এসব জিনিসের মূল্য কতটা।’
এছাড়াও অফিস প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায় ডেইলি স্টারের আরেক সংবাদকর্মীকে। তিনি বলেন, আগুনে শুধু অফিস নয়, পুড়ে গেছে তার বহুদিনের স্বপ্নও। তিনি বলেন, ‘আগামী রবিবার একটি ফ্ল্যাট কেনার কথা ছিল। সেই ফ্ল্যাট কেনার জন্য ধার করে জোগাড় করা ১০ লাখ টাকা তিনি অফিসে রেখেছিলেন, যা আগুনে পুড়ে গেছে। এ ছাড়া তার পাসপোর্টসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রও আগুনে নষ্ট হয়েছে।’
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে রাতভর বিক্ষোভ, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর : ওসমান হাদির হত্যার বিচারের দাবিতে রাজধানীতে উত্তাল হয়ে উঠেছে ছাত্র-জনতা। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন এলাকায় বিক্ষুব্ধ জনতা অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত আনুমানিক ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে বিক্ষোভকারীরা বাড়িটির আশপাশে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় তারা ‘হাদির রক্ত বৃথা যেতে দেবো না’, ‘আওয়ামী লীগের আস্তানা গুড়িয়ে দাও’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। কয়েকজনকে ভবনের একটি অংশে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করতে দেখা যায়।
ছায়ানট ভবনে হামলা-ভাঙচুর : রাজধানীর ধানমন্ডিতে অবস্থিত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট ভবনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে একদল বিক্ষুব্ধ জনতা। বৃহস্পতিবার দিনগত রাত ১টার দিকে বিক্ষুব্ধ জনতা ছায়ানট ভবনে প্রবেশ করে ভাঙচুর চালায়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ ও সেনাবাহিনী পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ধানমন্ডি মডেল থানার ডিউটি অফিসার মিঠুন সিংহ বলেন, বিক্ষুব্ধ জনতা ধানমন্ডিতে অবস্থিত ছায়ানট ভবন ভাঙচুর করেছে। পুলিশ ঘটনাস্থলে আছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়িতেও ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করে। চট্টগ্রামেও হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
রাজশাহীতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো আওয়ামী লীগের কার্যালয় : ওসমান হাদির হত্যার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার পর বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে জোহা চত্বরে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। পরে রাত ২টার দিকে ভেকু (এক্সেভেটর) দিয়ে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের অফিস গুঁড়িয়ে দেন বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা। এ সময় রাকসু জিএস সালাহউদ্দীন আম্মার বলেন, রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের কোনো অস্তিত্ব রাখা যাবে না। শেখ হাসিনা অনেক কাজ করে কিন্তু একটা কাজ করেনি সেটা হলো মুজিবের নামে পাবলিক টয়লেট। আমরা আওয়ামী কার্যালয়কে মুজিব পাবলিক টয়লেট বানাবো। রাবি ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি মুজাহিদ ফয়সাল বলেন, হাদির খুনিদের অতিবিলম্বের ফিরিয়ে আনতে হবে এবং ফাঁসি কার্যকর করতে হবে। নাহলে ভারতের সঙ্গে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখা যাবে না এবং ভারতের সব হাইকমিশনার বন্ধ থাকবে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের মতো কালচার ফ্যাসিস্টদের উৎখাত করতে হবে। শুক্রবার আমরা ভারতীয় হাইকমিশনার ঘেরাও করব। বোয়ালিয়া থানার পরিদর্শক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে ছাত্র-জনতা রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের অফিস বুলডোজার দিয়ে ভাঙচুর করেন। এর আগেও এই কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়েছিল।
সিলেটে প্রথম আলো অফিস ভাঙচুর : সিলেটে প্রথম আলো অফিসে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে বিক্ষুব্ধ জনতার একাংশ নগরীর পূর্ব জিন্দাবাজারস্থ প্রথম আলো অফিস ভাঙচুর করে। এর আগে বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে নগরীর চৌহাট্টা শহীদ মিনার এলাকায় অবস্থান করে বিক্ষোভ করেন ছাত্র-জনতা। রাতে হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে চৌহাট্টা পয়েন্টে জড়ো হতে থাকেন বিক্ষেব্দ ছাত্র-জনতা। সেখান থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। পরে ফের চৌহাট্টা এসে সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় তারা ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন। পাশাপাশি দ্রুত সময়ের মধ্যে হাদি হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান হয়। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রথম আলো অফিসেরর নিচে ঘটনার আগেই পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। তবে কিছু বিক্ষুব্ধ ব্যক্তি রাস্তা থেকে ইট পাটকেল ছুড়েন। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ভবন পরিদর্শন করলেন আইজিপি : ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় দৈনিক প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার ভবনে হামলা, ভাংচুর ও আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এ ঘটনায় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরিদর্শন করেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। শুক্রবার তিনি ভবন দুটি পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে পুলিশের এই শীর্ষ কর্মকর্তা ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের আশপাশে ঘুরে দেখেন। এসময় তিনি দায়িত্বরত কর্মকর্তার কাছে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা শোনেন। তবে পরিদর্শনকালে এ বিষয়ে আইজিপিকে প্রশ্ন করা হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
প্রথম আলোর ভবনে হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ, আলামত সংগ্রহে সিআইডি : ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় হামলা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয় প্রথম আলোর ভবন। এ ঘটনায় ভবনটি থেকে আলামত সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে সিআইডি। শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত দৈনিক প্রথম আলোর ভবনের এই আলামত সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। এ সময় সিআইডির একটি দল ভবনটির ভেতরে প্রবেশ করে। এরপর তারা টর্চ লাইট জ্বালিয়ে আলামত সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। এ সময় ভবনটির সামনে ক্রাইমসিন ফিতা ও বাঁশ বেঁধে জনসাধারণের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে দেয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ভবনটির বাইরে অবস্থান নেন।
শুক্রবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত দৈনিক প্রথম আলো ও ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের অফিস ঘুরে ধ্বংসস্তূপের চিত্র দেখা গেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, দৈনিক প্রথম আলো ও ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের অফিসে ভাঙচুর করা হয়েছে। আগুনের কালো ধোঁয়ার তীব্রতায় কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরো ভবন। উৎসুক জনতা ভিড় করতে দেখা যায়। ভবন দুটির প্রধান ফটকে দায়িত্বে আছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।