জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মুফতি জাকির হোসাইন খান কাসেমি। তিনি জামিয়া আরবিয়া দারুল উলুম নতুনবাগ মাদ্রাসার শাইখুল হাদিস এবং উচ্চতর ইসলামি আইন ও গবেষণা বিভাগের স্বনামধন্য শিক্ষক। তুখোড় মেধার অধিকারী মুফতি জাকির জীবনের পরতে পরতে রেখেছেন মেধার স্বাক্ষর। ইসলামি রাজনীতিকে হৃদয়ে লালন করে যেমন রাজপথে হুংকার ছাড়েন, তেমন ইলমি গভীরতায়ও তার তুলনা নেই। আকাবির-আসলাফের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তুলে ধরেন নিপুণ বক্তৃতার মাধ্যমে। তার জাগরণী বক্তৃতা শোনার জন্য পঙ্গপালের ন্যায় ছাত্রসমাজ জড়ো হতো। উকাবের ঝাণ্ডা নিয়ে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া সারা বাংলায় ছুটেছেন দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে।
জন্ম ও শিক্ষাদীক্ষা : মুফতি জাকির হোসাইন খান শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার ডিঙ্গামানিক ইউনিয়নে ১৯৭৮ সালের ৭ নভেম্বর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবুল কাসেম খান। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাইমারি তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াকালে শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া নন্দনশার মুহিউস সুন্নাহ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে মক্তব থেকে নাহবেমির পর্যন্ত অধ্যায়ন করেন। পাশাপাশি মাদ্রাসা-সংলগ্ন প্রাইমারি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার উদ্দেশে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী জামিয়া মাদানিয়া বারিধারায় ভর্তি হন। শরহে বেকায়া জামাত পর্যন্ত প্রত্যেক ক্লাসে প্রথম স্থান লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন। শরহে বেকায়া জামাতের বার্ষিক পরীক্ষার পর তার হৃদয়ে পবিত্র কোরআন হিফজের প্রবল আকাঙ্ক্ষা জাগে। মিরপুর খাদেমুল ইসলাম মাদ্রাসা সেকশন ১৩-এ ভর্তি হন। মাত্র ৫ মাস ১৩ দিনে পবিত্র কোরআন হিফজ করেন। এ ক্ষেত্রে মুফতি গোলাম মোস্তফা (রহ.) তার তত্ত্বাবধান করেন। কোরআন হিফজের পর তিনি জামিয়া দ্বীনিয়া শামসুল উলুম (পীরজঙ্গি মাদ্রাসা)-এ ভর্তি হয়ে হেদায়া, জালালাইন অধ্যায়ন করেন। পরবর্তীতে আবার জামিয়া মাদানিয়া বারিধারায় ভর্তি হয়ে মিশকাত জামাত সম্পন্ন করেন। ১৯৯৮ সালে সরকারের রোষানলে পড়ে জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা বন্ধ হয়ে যায়। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আল্লামা নুর হোসাইন কাসেমির তত্ত্বাবধানে জামিয়া সোবহানিয়া প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৯৯ সালে জামিয়া সোবহানিয়া থেকে তিনি দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেন। ১৯৯৯ সালের শেষ দিকে তিনি প্রাচ্যের দারুল আজহারখ্যাত বিশ্ববিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দ গমন করেন। অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করে ইলমে হাদিসের ওপর বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেন। দেওবন্দে তাকমিলুল হাদিস সমাপ্তির পর ভারতের সাবিলুস সায়লাম তামিলনাড়ুতে তাখাসসুস ফিল আদবে কিছুদিন পড়াশোনা করেন। এরপর গুজরাটের জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম কান্তাহারিয়ায় ভর্তি হন। ২০০১ সালে তাখাসসুস ফিল ইফতা তথা উচ্চতর ইসলামি ও আইন গবেষণার ওপর বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেন। দেশে ফিরে পাঠদানের পাশাপাশি ২০০৮ সালে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ইসলামিক স্ট্যাডিজের ওপর অনার্স-মাস্টার্স করেন।
অধ্যাপনা : ইফতা সম্পন্ন করার পর তিনি আবারো দেওবন্দে চলে যান। মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী (রহ.) ও আল্লামা খিজির কাশ্মীরির পরামর্শে উত্তরাখা- প্রদেশে রুড়কির মঙ্গলোরে আল্লামা খলিলুর রহমান সাহারানপুরী প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাতুল মুমিনিনে তাফসিরের শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপনা করেন। এ মাদ্রাসায় অধ্যাপনার সুবাদে আশপাশের বিভিন্ন মাদ্রাসার সঙ্গে তার শিক্ষাবিষয়ক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আশপাশের মাদ্রাসায় পরীক্ষক হিসেবে কাজের সুযোগ লাভ করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন দ্বীনি মাহফিলে আলোচক হিসেবে অংশ নেন। এরই সুবাদে রমজান মাসে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনারে তিন বছর তারাবি নামাজে ইমামতি করেন। এরপর দেশে ফিরে জামিয়া সোবহানিয়ায় শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০১০ সাল পর্যন্ত সেখানে ইলমে হাদিস, তাফসির, ফিকহসহ বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতার সঙ্গে পাঠদান করেন। ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি উত্তর বাড্ডা ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা ও জামিয়া বিন্নুরিয়া মিরপুর ১০-এ ইলমে হাদিস, তাফসির ইত্যাদি বিষয়ে পাঠদান করেন। ২০১৪ সালে আল্লামা নুর হোসাইন কাসেমি (রহ.)-এর নির্দেশে জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম নতুনবাগ মাদ্রাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে নিযুক্ত হন। বর্তমানে বোখারি, তিরমিজি, আল-আশবাহ ওয়ান নাজায়ের, হেদায়ার মতো উল্লেখযোগ্য কিতাবের পাঠদান সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে আঞ্জাম দিচ্ছেন।
ইসলামি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ : আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ছাত্রজীবন থেকেই ইসলামি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের অঙ্গসংগঠন ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন শেষে দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে দেশে ফেরার পর ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে ছাত্র জমিয়তের কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। এর আগে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক এবং ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্র জমিয়তের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের আমেলার সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় সহকারী মহাসচিব এবং বর্তমানে সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০৬ সালে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন’-এ বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ছাত্র ঐক্যের যুগ্ম-আহ্বায়ক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২০০৮ সালে মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক শাসনামলে শরিয়তপুর-২ আসন থেকে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য আলেমসমাজ ও আপামর জনতার অনুরোধে মনোনয়ন জমা দেন। কিন্তু জোট ও দলের সিদ্ধান্তে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন। বর্তমানে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের হয়ে বিশ দলীয় জোট থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী। ইসলামি রাজনীতি সম্পর্কে তার দর্শন হলো, ‘সকল পার্থিব লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও জাতির মুক্তির লক্ষ্যে এবং আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য খিলাফাহ আলা মিনহাজিন নবুওয়াহ প্রতিষ্ঠায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে। একে দ্বীনের অংশ মনে করে ইখলাস ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে। তবেই সত্যিকার ওয়ারিসে নবী হিসেবে জীবন স্বার্থক হবে।’
লেখক : কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ; সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্বি-মাসিক তাকবীর