বর্তমান বিশ্বে কিছু শহর নৈতিক অধঃপতন ও ধর্মীয় বিচ্যুতির জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। ইসরায়েলের রাজধানী তেলআবিব তেমন?ই একটি শহর। এখানে সমকামিতা, অশ্লীলতা, মাদকাসক্তি উৎসবমুখরভাবে পালন করা হয়। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সমকামি প্যারেড, পর্নোগ্রাফি শিল্পের প্রসার এবং মুসলিম নিপীড়নের প্রকাশ্য রাজনীতি- সব মিলিয়ে এ শহরের অবস্থান ইসলামি মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সম্পূর্ণ বিপরীতে। ইসলাম যেসব কাজকে সমাজ ও মানবতার জন্য ধ্বংসাত্মক সাব্যস্ত করেছে, তেল আবিব তার সবই গর্বের সঙ্গে ধারণ করছে। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে তাই এটি ‘পাপের শহর’ হিসেবে চিহ্নিত।
সমকামিতার বৈধতা ও প্রকাশ্য প্রচারণা : ইসরায়েলের অন্যতম প্রধান শহর তেলআবিব বর্তমানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ এলজিবিটি প্যারেড আয়োজনের জন্য পরিচিত। প্রতিবছর এখানে অনুষ্ঠিত হয় Gay Pride Parade। যেখানে প্রায় দুই লাখ মানুষ অংশগ্রহণ করে। এ গর্ব উৎসবে নগ্নতা, প্রকাশ্য চুম্বন, অশ্লীল পোশাক এবং বিকৃত যৌনাচারকে উৎসবের অংশ হিসেবে উদযাপন করা হয়। তেল আবিবে আইনগতভাবে সমকামিতা, সমকামি বিয়ে ও নগ্নতা বৈধ। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে সমকামিতা ভয়াবহ মহাপাপ। এ পাপই ছিল লুত (আ.)-এর জাতির ধ্বংসের কারণ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা কি পৃথিবীতে এমন অশ্লীলতা করছ, যা তোমাদের আগে কেউ করেনি? তোমরা তো নারীদের ছেড়ে পুরুষদের কাছে যৌনসুখ লাভ করছ। তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী এক জাতি।’ (সুরা আরাফ : ৮০-৮১)। এ পাপের কারণে লুত (আ.)-এর জাতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। তাদের শাস্তির বর্ণনা কোরআনে এসেছে, ‘অনন্তর আমি সে ভূখণ্ডটিকে উল্টে ওপর-নিচ করে দিলাম। তাদের ওপর পাকা মাটির পাথরধারা বর্ষণ করলাম।’ (সুরা হিজর : ৭৪)। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ অপরাধের কঠোর শাস্তির নির্দেশ দিয়েছেন, ‘তোমরা যে মানুষকে লুত সম্প্রদায়ের কুকর্মে (সমকামিতায়) নিয়োজিত পাবে, সেই কুকর্মকারীকে এবং যার সঙ্গে কুকর্ম করা হয়েছে, তাকে মেরে ফেলবে।’ (তিরমিজি : ১৪৫৬)। আজকের তেলআবিব সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির আধুনিক সংস্করণ হয়ে উঠেছে।
মদ্যপান ও মাদকদ্রব্য ব্যবহার : তেল আবিব শহরকে বলা হয় ‘২৪/৭ পার্টি সিটি’। অর্থাৎ এটি এমন শহর, যেখানে দিনরাত অবিরাম মদ্যপান, হ্যাশিশ ও ক্যানাবিস সেবন, নাইটক্লাব, অশ্লীলতা ও নেশার সংস্কৃতি বিরাজ করে। অ্যালকোহল, জুয়া- সবকিছুই সেখানে বৈধ ও জনপ্রিয়। তাদের এ বেপরোয়া জীবনধারা সম্পর্কে ইসলামে স্পষ্ট ও কঠোর নিষেধাজ্ঞা এসেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনগণ! নিশ্চয় মদণ্ডজুয়া, প্রতিমার বেদি ও জুয়ার তীর অপবিত্র, শয়তানি কাজ। সুতরাং এসব পরিহার কর। যাতে তোমরা সফলতা অর্জন করতে পার।’ (সুরা মায়িদা : ৯০)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক নেশাদায়ক বস্তুই হারাম।’ (বোখারি : ৫৫৮৫)।
নগ্নতা ও অশ্লীলতার সয়লাব : তেলআবিবে বহু নগ্ন সৈকত রয়েছে, যেখানে নারী-পুরুষ সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় অবাধে বিচরণ করে। ক্লাব ও বারে চলে অশ্লীল নৃত্য। যা কখনও কখনও সরাসরি টেলিভিশন বা অনলাইনে সম্প্রচারও করা হয়। প্রতিবছর ৫০০-এরও বেশি নাইটক্লাবে প্রকাশ্যে অ্যালকোহল সেবন, নগ্নতা ও যৌন উদ্দীপনামূলক কর্মকাণ্ড চালু থাকে। মদ্যপান, যৌন পার্টি এবং বিকৃত জীবনযাপন তেলআবিবের স্বাভাবিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলাম এসব কর্মকাণ্ডকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। কোরআন-হাদিসে বারবার মানুষকে সতর্ক করা হয়েছে লজ্জাশীলতা, পবিত্রতা ও আত্মসংযমের শিক্ষা দিয়ে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা অশ্লীলতার কাছেও যেও না। এটা অবশ্যই অশ্লীল কাজ এবং নিকৃষ্ট পথ।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৩২)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো জাতির মধ্যে ব্যভিচার ও সুদের প্রসার ঘটে, তখন আল্লাহর শাস্তি অবধারিতভাবে তাদের ওপর আসে।’ (মুস্তাদরাকে হাকিম : ৮৫৭৪)।
পর্নোগ্রাফি শিল্পের অন্যতম কেন্দ্র : বিশ্বের পর্নোগ্রাফি শিল্পের অন্যতম বৃহৎকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে ইসরাইল। একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বিশ্বব্যাপী অনলাইনে প্রচারিত পর্নোগ্রাফিক কনটেন্টের অন্তত ৬০ শতাংশের প্রোডাকশন, প্রক্রিয়াকরণ ও পরিচালনা হয়ে থাকে ইসরাইলের রাজধানী তেলআবিব ঘিরে। পর্নোগ্রাফিক ভিডিও তৈরির পাশাপাশি এটি পরিচালনা, বিপণন এবং প্রযুক্তিগত সহায়তার ক্ষেত্রেও সক্রিয়ভাবে জড়িত। যা গুরুতর অপরাধ। ইসলাম পর্নোগ্রাফি এবং যেকোনো ধরনের অশ্লীলতা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মোমিনদের বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটি তাদের জন্য পবিত্রতর।’ (সুরা নুর : ৩০)। রাসুলুল্লাহ (সা.) অশ্লীলতার পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ার করেছেন, ‘অশ্লীলতা যখন কোনো সম্প্রদায়ে প্রকাশ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তাদের মধ্যে প্লেগ ও নতুন রোগ-ব্যাধি ছড়ায়; যা পূর্ববর্তী জাতিগুলোর মধ্যে ছিল না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪০১৯)।
ধর্মহীনতা ও ইসলামবিদ্বেষের আস্তানা : তেল আবিবে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ধর্মীয় জ্ঞান থেকে প্রায় পুরোপুরি মুক্ত। ধর্মহীন এ পরিবেশে ইসলামকে অবমাননা করা যেন একপ্রকার মুক্তচিন্তা ও শিল্পসৃষ্টি হিসেবে অনুমোদন পায়। কোরআন পোড়ানো, ইসলামি প্রতীক ও নিদর্শন বিকৃত করা, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ব্যঙ্গ করে চিত্রায়িত করা, এমনকি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন কর্মকাণ্ড প্রায়ই এখানে সংঘটিত হয়। অথচ ইসলামে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর সম্মান রক্ষাকে ঈমানের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। তাঁদের প্রতি অবমাননা কিংবা বিদ্বেষ প্রদর্শন শুধু নিন্দনীয় নয়, বরং তা মারাত্মক অপরাধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে কষ্ট দেয়, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে রয়েছে লাঞ্ছনা ও অপমান।’ (সুরা আহজাব : ৫৭)।
ফিলিস্তিনিদের ওপর জুলুম ও দখলদারিত্ব : ইসরায়েলের রাজধানী তেলআবিব থেকেই নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্বিচারে বোমাবর্ষণ, মানুষ হত্যা, ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং মসজিদে আগ্রাসনের মতো ভয়াবহ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। তেলআবিবের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা মূলত গড়ে উঠেছে ফিলিস্তিনিদের রক্ত, জমি ও অশ্রুর ওপর ভিত্তি করে। এ শহরই গাজার ওপর আগ্রাসন চালানোর নীতি নির্ধারণ করে। যেখানে প্রতিনিয়ত নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। অথচ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি একটি প্রাণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে কিংবা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল।’ (সুরা মায়িদা : ৩২)। তেল আবিবের দখলদারিত্বের রাজনীতি ফিলিস্তিনিদের জমি দখল, মসজিদ ধ্বংস করা, শিশুদের হত্যা করাসহ বিভিন্নভাবে জুলুম ও নির্যাতন করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা জুলুম করেছে, অচিরেই তারা জানতে পারবে- কোন পরিণামের দিকে ফিরে যাচ্ছে।’ (সুরা শুআরা : ২২৭)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে এক বিঘত জমি দখল করবে, কেয়ামতের দিন তা তার গলার ওপর সাত স্তর জমির বোঝা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হবে।’ (বোখারি : ২৪৫৪)।
লেখক : আলেম ও প্রাবন্ধিক