বায়াত অর্থ প্রতিশ্রুতি বা আনুগত্যের অঙ্গীকার। এর মাধ্যমে একজন মুমিন আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-এর প্রতি আত্মসমর্পণ করে দ্বীন মেনে চলার শপথ গ্রহণ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে পুরুষ সাহাবীগণ ঈমান, হিজরত, জিহাদ, চারিত্রিক পবিত্রতা ও ইসলামি অনুশাসন পালনের জন্য যেমন বায়াত করতেন, তেমনি নারীরাও করতেন। তবে নারীদের বায়াতের পদ্ধতি ছিল স্বতন্ত্র, শালীনতা ও পর্দানীতি বজায় রেখে। এগুলো জানা থাকলে নারীদের আত্মশুদ্ধির পথ সুগম হয়। ভুলভ্রান্তি থেকে সহজেই রেহাই পাওয়া যায়।
নারীদের প্রথম বায়াত : ইসলামের ইতিহাসে প্রথম বায়াত নবুওয়াতের দশম বছরে হজের মৌসুমে সংঘটিত হয়। তখন মদিনার ৬ জন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে ঈমান ও আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে। এটাই ছিল আকাবার প্রথম শপথ। নবুয়তের ১৩তম বছর মদিনার ৭৫ জন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে ৭৩ জন পুরুষ এবং দুজন নারী ছিলেন। এটাই ছিল ইতিহাসে নারীদের প্রথম বায়াত গ্রহণের ঘটনা। নারী দুজনের একজন ছিলেন উম্মে উমারা নুসায়বা বিনতে কাব। দ্বিতীয় জন ছিলেন উম্মে মানী আসমা বিনতে আমর। (ইবনে হিশাম : ১/৪৪০-৪৪১)।
কোরআনে নারীদের বায়াত : রাসুলুল্লাহ (সা.) ইসলাম গ্রহণকারী নারীদের থেকে সমাজে প্রচলিত বড় বড় দোষত্রুটি থেকে মুক্ত থাকার জন্য প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন। ইসলামের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত যাবতীয় কল্যাণ ও মঙ্গলময় নিয়মনীতি, আইন-কানুন অনুসরণ ও পালন করে চলতে তাদের বাধ্য ও প্রস্তুত থাকার বায়াত নিয়েছেন। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, হে নবী! মুসলিম নারীগণ যখন তোমার কাছে এই মর্মে বায়াত করতে আসে যে, তারা আল্লাহর সঙ্গে কোনো জিনিসকেই শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, নিজেদের সন্তানদের হত্যা করবে না, এমন কোনো অপবাদ রটাবে না, যা তারা নিজেদের হাত-পায়ের মাঝখান থেকে রচনা করেছে এবং কোনো ভালো কাজে তোমার অবাধ্যতা করবে না, তখন তুমি তাদের বায়াত গ্রহণ করো এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে মাগফিরাতের দোয়া করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা মুমতাহিনা : আয়াত-১২)।
নারীদের বায়াতের পদ্ধতি : রাসুলুল্লাহ (সা.) হাতে হাত রাখার মাধ্যমে সাহাবায়ে কেরামের বায়াত নিতেন। কিন্তু নারীদের বায়াতের ক্ষেত্রে কখনো তিনি হাতে হাত মিলাতেন না। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করো না এই আয়াত পাঠ করে স্ত্রীলোকদের কাছ থেকে বায়াত নিতেন। তিনি আরও বলেন, বৈধ অধিকারপ্রাপ্ত মহিলা ছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাত অন্য কোনো স্ত্রীলোকের হাত স্পর্শ করেনি। (বোখারি : ৬৭২১) মক্কা বিজয়ের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) সাফা পর্বতের ওপর অবস্থান করে প্রথমে পুরুষদের বায়াত গ্রহণ করেন। এরপর নারীদের বায়াত গ্রহণ করেন।
উঁচু স্থান থেকে তিনি শপথ বাক্য পাঠ করেছিলেন আর ওমর (রা.) তা নারীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। নারীরা তার কাছ থেকে শুনে শুনে শপথ বাক্য পাঠ করেছিলেন। হাতে হাত রেখে বায়াত করার প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। উমায়মা বিনতে রুকায়কা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি কয়েকজন আনসারী নারীর সাথে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে বায়াত গ্রহণের জন্য উপস্থিত হই।
আমরা আরজ করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা আপনার কাছে একথার উপর বায়াত করছি যে, আমরা আল্লাহতায়ালার সাথে কাউকে শরীক করব না, চুরি করব না, ব্যাভিচার করব না, আমরা কারো প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেব না, ভালো কাজে আপনার নাফরমানি করবো না। তিনি বললেন, তোমরা এও বল যে, আমাদের দ্বারা যতটুকু সম্ভব। উমায়মা (রা.) বলেন, আমরা বললাম, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল আমাদের প্রতি কত মেহেরবান। আমরা বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আসুন, আমরা আপনার হাতে বায়াত গ্রহণ করব। তখন রাসুল (সা.) বললেন, আমি স্ত্রীলোকের হাতে হাত মিলাই না। কেননা, একজন নারীকে আমার বলাটা একশত নারীকে বলার মতো। (নাসায়ি : ৪১৮১, ইবনে মাজা : ২৮৭৪)।
যে বিষয়ে বায়াত নিয়েছেন : রাসুলুল্লাহ (সা.) একাধিক বিষয়ে একাধিকবার নারী সাহাবীদের বায়াত নিয়েছেন। সুরা মুমতাহিনার ১২ নাম্বার আয়াতে ছয়টি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি নারীরা যেন বিলাপ করে কান্নাকাটি না করে সে বিষয়েও বায়াত নেওয়া হয়েছিল। উম্মে আতিয়্যা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন এ আয়াত নাজিল হলো, হে নবী! মুমিন মাহিলারা যখন তোমার কাছে এসে বায়াত করে এ মর্মে যে, তারা আল্লাহর সঙ্গে কোনো শরীক করবে না এবং সৎকার্জে তোমার অমান্যতা করবে না... ( সুরা মুমতাহিনা, আয়াত : ১২) উম্মে আতিয়্যা (রা.) বলেন, তন্মধ্যে বিলাপও ছিল। তখন আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! অমুক পরিবার ছাড়া। কারণ, তারা জাহিলিয়াতের যুগে আমাকে বিলাপে সাহায্য করত। তাই আমারও কর্তব্য তাদের সাহায্য করা। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, অমুক পরিবার ছাড়া। (মুসলিম : ২০৩৬)।
প্রচলিত বায়াতে সতর্কতা : বর্তমানে কিছু সংগঠন ও পীর-মুরীদদের মধ্যে হাতে হাত রেখে বায়াতের রেওয়াজ এখনও অব্যাহত আছে। ক্ষেত্র বিশেষে এর গুরুত্ব থাকলেও হাতের উপর হাত রেখে বায়াত হওয়া আবশ্যক নয়। পীরের নির্দেশনা অনুযায়ী চলাই হলো প্রকৃত বায়াত। আনুষ্ঠানিক বায়াত জরুরি নয়। অনেক সময় হক্কানী পীর সাহেবগণ রুমাল বা পাগড়ি বিছিয়ে দিয়ে বায়আত করান, তখন নারীরা পর্দার আড়ালে থাকেন। নারীদের আত্মশুদ্ধির ক্ষেত্রে নিরাপদ উপায় হলো চিঠিপত্র আদান-প্রদান করা অথবা অন্য কারো মাধ্যমে বায়াত গ্রহণ করা। তবে পীর শরিয়তের পূর্ণাঙ্গ অনুসারী কি না, সেটা আগে দেখে নিতে হবে। কেননা, বর্তমানে একশ্রেণির শরিয়তবিরোধী ভণ্ডপীর বায়াতের নামে নারী পুরুষদের নিজের স্বার্থের উসিলা বানানো এবং মানুষের দ্বীন-ধর্মকে বরবাদ করার ফাঁদ পেতে রেখেছে। তাই এ ব্যাপারে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।