ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৬/১১)

নবীজির (সা.) সান্নিধ্যে সদ্যমুক্ত বেলাল হাবশি

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
নবীজির (সা.) সান্নিধ্যে সদ্যমুক্ত বেলাল হাবশি

আমার কালো দাসের জন্য যদি তোমার এতই দরদ, নগদ মূল্য দাও। উচিত মূল্যে কিনে নাও। পকেটের টাকা খরচ না করে মুখের জোরে জিততে চাও, তা হবে না। আবু বকর (রা.) উমাইয়া ইবনে খালাফের কথা শুনে দারুণ খুশি হলেন। বললেন, ধন্যবাদ তোমাকে। তোমার গোলাম বেলালের বিনিময়ে দিতে চাই আমার একটি গোলাম। দেখতে সুদর্শন, সুঠামদেহী, তবে তোমার মতোই কাফের। গায়ের চামড়া সাদা তবে অন্তরটা কালো। তার বিনিময়ে নিতে চাই গায়ের চামড়া কালো বেলালকে, যার অন্তরে আলো। কথাবার্তার ফাঁকে লোক পাঠিয়ে নিয়ে আসলেন সুঠামদেহী সেই গোলাম। সত্যিই খুবই সুন্দর তার গড়ন। দেখে তো কুরাইশ নেতা হতবাক। এমন গোলমের বিনিময়ে কীভাবে নিতে চায় একটি কদাকার দাস। আনিত গোলামের দেহশৈষ্ঠব দেখে তার পাথরের মতো কঠিন হৃদয়ও বিগলিত হলো। আসলে যারা বহ্যিকতা, বস্তুর পূজারি তারা বাইরের চাকচিক্য জৌঁলুস দেখে সহজে মজে যায়। তারা শুধু বাইরের চাকচিক্য দেখে, ভেতরের সৌন্দর্য দেখার সুযোগ তাদের নেই। কারণ, তাদের অন্তর রুহের আলো থেকে বঞ্চিত।

উমাইয়ার কালো অন্তরটা আবার ডিগবাজি খেল। বেলালের প্রতি আবু বকর (রা.)-এর আগ্রহ দেখে তার লোভের আগুন জ্বলে উঠল। বলল, দাসের বদলায় দাস দিলে চলবে না, আমি রাজি হব না। আমাকে এই দাস তো দেবে তার ওপর বাড়তি আরও টাকা দিতে হবে। আবু বকর (রা.) তার কথায় সায় দিয়ে রাজি হলেন। বললেন, মোটা একটি অংক দিলাম, তবুও রাজি হও। বেলালকে আমার হাতে বুঝিয়ে দাও।

আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর কথা শুনে উমাইয়ার অট্টহাসি দেখে কে। তার হাসি ছিল বিদ্রুপ, ঠাট্টা, ব্যাঙ্গ আর বিদ্বেষে বিষাক্ত। আবু বকর (রা.) বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, আমার কথায় তুমি কেন এভাবে হাসলে। তাতে কাফের আবারও হাসল, বিজয়ের আনন্দ তার চোখে-মুখে। আবু বকর, এই কালো গোলামটির জন্য তুমি যদি এত আগ্রহী না হতে, তা হলে অল্প দামেই তো আমি ছেড়ে দিতাম। জ্ঞানী লোক হয়ে এমন লোকসান কীভাবে গুনলে, সে কথা চিন্তা করেই আমি হাসলাম। তুমি পীড়াপীড়ি না করলে বর্তমান দামের চেয়ে দশ ভাগ কম দামে আমি তাকে দিয়ে দিতাম। জানো, এই কালো আদমিটার দু’পয়সার দাম নেই আমার কাছে। তুমিই তার দাম বড়িয়ে ঠকে গেছ আমার কাছে।

কাফেরের কথার জবাব দিলেন আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। উমাইয়া! কী বলতে চাও তুমি। আমি তো শিশুর হাতে মোয়া দিয়ে মণিরত্ন হাত করেছি। মা-বাবার অজান্তে ধনির ঘরের শিশুরা যদি মণিরত্ন নিয়ে খেলে, কেউ তার হাতে মিষ্টান্ন দিলে বিনিময়ে মণিরত্নটি দিয়ে দেয় অনায়াসে। তুমিও তো এক মহামূল্য কালো মানিক দিয়ে দিলে আমাকে অতি অল্প দামে।

কু বে নজদে মন হামি আরজদ দো কউন

মন বে জানাশ নাজেরাস্তম তো বে লউন

আমার কাছে তার মূল্য উভয় জগতের সমান

তুমি মুগ্ধ গায়ের রঙে আমি চাই তার প্রাণ।

সে তো হলুদ বরণ স্বর্ণ, রাখা হয়েছে কালো পোটলায় তাকে। যেন কোনো আহম্মক বুঝতে না পারে তার ভেতরে কী আছে। দূরদেশের মুসাফিররা মূল্যবান স্বর্ণরৌপ্য লুকিয়ে রাখে মূল্যহীন পোটলায়। যেন সে দিকে কোনো চোর-ডাকাতের খেয়াল না যায়। যারা এই সাত রঙের দুনিয়ায় বাহ্যিক চাকচিক্যের পূজারি তারা বাইরের জৌলুস ঝিকিমিকি দেখে বিমুগ্ধ হয়। বাইরের আচ্ছাদনের ভেতরে লুকায়িত রত্ন দেখার ভাগ্যবান তারা নয়। আসল ব্যাপার, তুমি যদি বেলালকে বিক্রি করতে আরও গড়িমসি করতে, তোমাকে রাজি করার জন্য দিয়ে দিতাম আমার সম্পদ যা আছে। তাতেও যদি রাজি না হতে ধারকর্য করে হলেও নিয়ে যেতাম তাকে। কাজেই আমি নই তুমিই ঠকেছ এই লেনদেনে। তুমি মণিরত্ন দেখনি, কালো পোটলার ভেতর কী আছে খুলে দেখনি। তোমার মূর্খতা এই কালো পোটলা খোলার সুযোগ তোমাকে দেয়নি।

অচিরেই তুমি বুঝতে পারবে কেমন রত্ন হাতছাড়া করলে পানির দামে। তোমার কাছে সৌভাগ্যের হাতছানি এসেছিল কালো গোলামের জামা গায়ে জড়িয়ে। তোমার হতভাগা চোখ দেখতে পায়নি তার ভেতরে কী রত্ন আছে লুকিয়ে। তুমি শুধু দেখেছ তার দাসত্ব কেমন। তার ভেতরে রাজকীয় মহিমা দেখোনি, ওহে পোড়া কপাল। যাইহোক হে উমাইয়া, নাও এই অর্থ আর সুঠামদেহী সুন্দর চামড়ার গোলাম, তোমার মতোই সে মূর্তি পূজারি, কলুষিত মন। এই লেনদেনে তুমিও লাভবান হলে আর আমার মুনাফা তো বিস্তর। তোমার জন্য তোমার ধর্ম, আমার ধর্ম আমার। তবে তোমার লাভ সাময়িক আর আমার মুনাফা চিরন্তন।

মূর্তিপূজারিরা এভাবেই প্রতারিত হয় বাইরের রঙরূপ দেখে। পিতলের মূর্তি সাজিয়ে কারুকাজ করে বিরাট মূল্যে কেনে। তাদের এই কেনা, এভাবে পূজা পিতলের অশ্বভাষকর্য কেনার মতোই। প্রাণহীন অশ্ব বাহন হতে পারে না, এই কথা বুঝে না মূর্তিপূজারি আহম্মক। তাদের অবস্থা কাফেরের কবরের মতো। বাইরে জৌলুস কারুকাজ মন্দিরের মহামুনির সাজ। অথচ ভেতরে নরকের অনল জ্বলে বুঝতে পারে না কেমন মূর্খতা।

হামচো মালে জালেমান বিরুন জামাল

ওয়ায দরুনাশ খোনে মজলুম ও ওবাল

জালিমের সম্পদ যেমন বাইরে জৌলুস

ভেতরে মজলুমানের বুকের রক্তের চোপ।

কাফেরদের অবস্থা জালিমের সম্পদের মতো। বাইরে দেখতে অঢেল সম্পদ অট্টালিকা সারি সারি। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখ, এই সম্পদের ভেতরে মজলুম মানুষের চোপ চোপ রক্ত জমাট, গুমরে ফিরে মজলুমানের আহাজারি। মুনাফিকদের অবস্থার সঙ্গে তুলনীয় তাদের স্বরূপ। মুনাফিকরা বাহ্যিকভাবে নামাজ পড়ে, রোজা রাখে; কিন্তু তাদের অন্তর দ্বীন ঈমানের শত্রুতায় কলুষিত থাকে। তাদের বাইরে রোজা, নামাজের ধর্মীয় লেবাস; অথচ ভেতরে কালো মাটি, হয় না যেখানে সততা, নেক আমলের উদ্ভিদের চাষ।

কাফের সর্দার উমাইয়ার অবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়; তাই সে বঞ্চিত হয় বেলালের অন্তর্গত সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হতে। এবার আবু বকর সিদ্দিক (রা.) হাতে ধরে উঠালেন বেললকে। অত্যাচার উৎপীড়ন সয়ে তার শরীরটা দাঁতের খিলালের মতো চিকন লিকলিকে। জীর্ণশীর্ণ বেলালকে নিয়ে চললেন নবুয়াতের দরবার পানে। দূর থেকে বেলাল যখন নুরনবীর আলোকিত চেহারা দেখতে পেলেন, আবু বকরের হাত ফসকে পড়ে গেলেন মাটিতে। শোকে, আবেগে বেলাল বেহুঁশ সম্বিতহারা। অনেকক্ষণ পর বেলালের হুঁশ ফিরল, তখন শুরু হলো আনন্দে-আবেগে দুনয়নে অশ্রুর বরিষণ।

মুস্তফা আশ দর কেনারে খোদ কশিদ

কাস চে দানদ বখশিশি কু রা রসিদ

নবী মুস্তফা নিলেন জড়িয়ে বুকে বসালেন পাশে

কে জানে কত দান পেলেন বেলাল নবীজির কাছে।

নবীজি (সা.) বেলালকে বরণ করে নিলেন, বুকে জড়ালেন, কাছে বসালেন। এই ফাঁকে কত দয়াদানে বেলাল ধন্য হলেন তার হিসাব কে জানে। সান্নিধ্যের উঞ্চতায় নবীজির এই দয়াদান ছিল অঘোষিত নিঃশব্দ ভাষাহীন। এই দানের মাহাত্ম্য বোঝার জন্য একটি উদাহরণ প্রয়োজন। বলা হয়, তামা যখন পরশ পাথরে সংস্পর্শে আসে স্বর্ণে রূপান্তরিত হয় সঙ্গে সঙ্গে। কিংবা কোনো দরিদ্র যখন গুপ্তধন পায় তার কী অবস্থা হয়। বেলাল আধমরা মাছের মতো। সাগরের পানিতে পথ খুঁজে পেলে ডাঙ্গার মাছের কী অবস্থা হয়। মরুর পথে মুসাফির রওনা হয় দূর দেশে। যদি পথ হারায় প্রতিক্ষণে প্রহর গুণে মৃত্যুর অপেক্ষায়। আবার যখন পথ খুঁজে পায় জীবন ফিরে পাওয়ার আনন্দ মনে দোল খায়। বেলালের অবস্থাও ছিল তাই। যেসব ভাষাহীন উচ্চারণে সেদিন নবীজি বলেন বেলালের মনের কানে, যদি তার হাকিকত অমাবশ্যার রাতের বুকে প্রকাশিত হয়, তা হলে রাত-দিন হয়ে যাবে আলোর প্রভাবে। আর যদি দিনের আলোতে রাখা হয়, সে দিনের সম্ভাষণের মাহাত্ম্য দিনের আলো সহ্য করতে পারবে না, রূপান্তরিত হবে নিশিরাতের নিকর্ষ কালোতে।

তুমি হিসাব করে দেখ, যখন আষাঢ়ে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে তখন বৃষ্টি কী কী কথা বলে ফল, ফুল উদ্ভিদের কানে কানে। আল্লাহর শিল্পনৈপুণ্য এভাবেই তো কথা বলে সৃষ্টিলোকের পরতে পরতে। তাতে প্রকৃতি জাগে প্রাণের জোয়ারে জীবন জাগার স্পন্দনে। আল্লাহর রহমত তখন কথা বলে বিভিন্ন প্রভাবক হয়ে। সে কথা নিঃশব্দে, ভাষাহীন উচ্চারণে। আল্লাহর পবিত্র নামসমূহ ও গুণাবলির প্রকাশ ঘটে এভাবেই বিশ্ব চরাচরে। তুমি মনে করো না পৃথিবী, তার প্রকৃতি এমনিতে আলোড়িত হয়, ঋতুচক্রের বিবর্তন আসে। শীতের পর বসন্তের আগমন প্রকৃতির নিয়মে; বরং তার মাঝে সক্রিয় থাকে ভাগ্যের বিধান, আল্লাহর সৃষ্টি নৈপুণ্যের কলাকুশল। বস্তুবাদী মূর্তিপূজারির দৃষ্টি সংকীর্ণ, তাদের আকল জ্ঞানবুদ্ধি ঊর্ধ্বলোকে অগম্য তাই তারা বুঝতে পারে না সৃষ্টিলোকের এত রূপ বৈচিত্রের অপার রহস্য।

আবু বকর (রা.) নবীজি (সা.)-কে বললেন, বেলালকে আমি মুক্ত করে দিলাম আপনার সন্তুষ্টির খাতিরে। নবীজি বললেন, কথা তো ছিল, তার দাম তুমি অর্ধেক দেবে, আমি দেব বাকি অর্ধেক। কিন্তু তুমি একাই কিনে আনলে। কেন এমন কাজটি করলে? (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : ৬, বয়েত : ১০২৬-১০৭৪)

(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত