পৃথিবীর জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া, হাসি-কান্না, সম্পর্ক ও আবেগ- সব কিছুর এক অবশ্যম্ভাবী সমাপ্তি ঘটায় মৃত্যু। মৃত্যু কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই ছিনিয়ে নিতে পারে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি- মাতা, পিতা, ভাই, বোন, পুত্র, কন্যা, চাচা, মামা বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে।
জীবনের পথচলায় যারা ছিল অবিচ্ছেদ্য অংশীদার, যাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া হয়েছিল জীবনের সব সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, তাদের হঠাৎ বিদায় শুধুই এক শূন্যতা নয়, এটি হৃদয়ে একটি গভীর ক্ষতের জন্ম দেয়। একজন প্রিয়জনের মৃত্যু শুধু একটি ব্যক্তিকে নয়, গোটা পরিবারকে স্তব্ধ করে দেয়। যিনি চলে যান, তিনি শুধু তাদের কাছের একজন নন, তিনি একজন ভালোবাসার আশ্রয়, একজন জীবনের সাহচর্য। তাই এই চিরবিদায়ে পরিবার-পরিজন অনুভব করেন এক অপ্রস্তুত অভাব, এক অবর্ণনীয় শোক।
যখন কেউ তার প্রিয়জনকে হারান, তখন সে শোক এমন এক বেদনায় পরিণত হয়, যা শব্দে প্রকাশ করা যায় না। প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর পাওয়ার সেই প্রথম মুহূর্তটি এটাই জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তগুলোর একটি। ওই মুহূর্তে হৃদয় যেন থেমে যায়, সময় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায় এবং মন বোঝার চেষ্টা করে আপন মানুষটি আর কখনও ফিরে আসবে না। শিশুর মৃত্যু কোনো শাস্তি নয়, বরং এক কঠিন পরীক্ষা- যার উত্তীর্ণ হলে মা-বাবা পেতে পারেন জান্নাতের সুউচ্চ মর্যাদা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর অবশ্যই আমি তোমাদের ভয় ও ক্ষুধা দ্বারা এবং ধন-সম্পদ, জান-মাল ও ফল-ফসলের কিছু ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করব। আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা বাকারা : ১৫৫)।
এই আয়াতে আল্লাহ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে জানমালের ক্ষতি জীবনের একটি বাস্তবতা এবং তা পরীক্ষাস্বরূপ আসে। সন্তানের মৃত্যু নিঃসন্দেহে জানের ক্ষতি, যা সব চেয়ে হৃদয়বিদারক। কিন্তু যারা এ পরীক্ষায় ধৈর্য ধারণ করেন, আল্লাহ তাদের জন্য সুসংবাদ দিয়েছেন।
কারও মৃত্যুর খবর শুধু একটি সংবাদ নয়, এটি জীবনের এক চিরস্থায়ী শূন্যতার ঘোষণা। সেই মুহূর্তে মানুষ অনুভব করে, তার হৃদয়ের একটি অংশ যেন চিরতরে ছিন্ন হয়ে গেছে। যিনি চলে গেছেন, তিনি শুধু একজন মানুষ নন, তিনি ভালোবাসা, স্মৃতি, সাহচর্য আর নির্ভরতার প্রতীক। এই দুর্বিষহ সময়ে শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সান্ত¡না দেওয়া একটি মানবিক দায়িত্ব। তাদের পাশে দাঁড়ানো, কোমল ভাষায় সমবেদনা জানানো, চোখে চোখ রেখে নীরবভাবে সহানুভূতি প্রকাশ করাও হতে পারে বিশাল এক শান্তির উৎস।
এটি একটি চিরাচরিত মানবিক ঐতিহ্য, যা মানুষ যুগে যুগে পালন করে এসেছে। প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা কোনো কিছু দিয়েই পূর্ণভাবে মোছা যায় না, কিন্তু একটি সহানুভূতির শব্দ, একটি সান্ত¡নার স্পর্শ, একটি সাহচর্যপূর্ণ উপস্থিতি শোককে কিছুটা হলেও লাঘব করতে পারে। এই মানবিক মূল্যবোধই আমাদের সমাজকে আরো মমতাময় করে তোলে। শোকসন্তপ্ত মানুষদের সান্ত¡না দেওয়ার পথ একক নয়, বরং বহুমাত্রিক ও সংবেদনশীল একটি প্রক্রিয়া। একজন প্রিয়জনকে হারানোর কষ্ট এমনই গভীর যে তা কোনো একটি মাত্র অভিব্যক্তিতে মোচন সম্ভব নয়। তাই এ সময়ে আমাদের আচরণ, উপস্থিতি এবং কথা সবই হতে পারে তাদের জন্য সান্ত¡নার উৎস।
শোকের সংবাদ পাওয়ার প্রথম মুহূর্তেই সান্ত¡নার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
এই সময়ে শোকাহত পরিবারকে সহানুভূতির সঙ্গে স্পর্শ করা, কোমল ভাষায় সমবেদনা জানানো এবং তাদের পাশে দাঁড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু কথা নয়, নীরব উপস্থিতিও অনেক সময় বিশাল প্রভাব ফেলে। একটি বাস্তবতা হলো প্রিয়জন হারানোর খবর যখন ছড়িয়ে পড়ে, তখন আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের উপস্থিতি শোকাহত পরিবারকে অনেকটা মানসিক শক্তি জোগাতে থাকে। এমনকি একটুখানি সহানুভূতিও তাদের শোকের ভার কিছুটা হলেও হালকা করতে সহায় হয়।
এ ছাড়া যারা মৃত ব্যক্তিকে চিনতেন, তাদের উচিত মৃতের সৎকার সম্পর্কিত কাজগুলো যেমন- গোসল, জানাজা, দাফন, হাসপাতালের কাজকর্ম এবং শোকগৃহের দেখভাল- তাদের ওপর থেকে কিছুটা দায়িত্ব তুলে নেওয়া। এটি শোকাহত পরিবারের মানসিক চাপ কমাতে উল্লেখযোগ্যভাবে সাহায্য করে। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) শোকগ্রস্ত পরিবারদের জন্য খাবার প্রস্তুত করতে সাহাবিদের উৎসাহিত করেছেন, কারণ শোকের ভারে তারাও অনেক সময় খাওয়া বা রান্নার মতো সাধারণ কাজ করতেও অক্ষম হয়ে পড়ে। এ থেকেই বোঝা যায়, সহানুভূতি শুধু কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং কাজের মাধ্যমেও তা প্রকাশ পায়।
শোকের পরবর্তী সময়গুলোতেও পরিবারের পাশে থাকা জরুরি। শোককাল শেষ হলেও সম্পর্কের বন্ধন যেন শেষ না হয়, বরং নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, খোঁজখবর নেওয়া এবং স্মরণ করিয়ে দেওয়া- তারা একা নয়, এই মানবিক আচরণ একটি পরিবারকে নতুন করে বাঁচার সাহস জোগায়। একজন মুসলমানের ওপর দায়িত্ব হলো, তার কোনো মুসলিম ভাই বা বোন যখন প্রিয়জন হারানোর মতো কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তখন সে যেন তার প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে এবং সান্ত¡না দেয়। এটি শুধু মানবিক দায়িত্বই নয়, বরং একটি মহৎ কাজও বটে এবং ইসলামের মহান শিক্ষাগুলোর মধ্যেও অন্যতম। এ সময় তাদের ধৈর্যের প্রতি উৎসাহিত করা, তাকদিরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকার উপদেশ দেওয়া এবং এমন সব কথা বলা উচিত যা তাদের অন্তরে আশা ও আস্থা জোগায় এবং যা ইসলামের সীমার মধ্যে থাকে। আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.) নিজে বহুবার শোকাহত পরিবারকে সান্ত¡না দিয়েছেন।
তার বলার ভঙ্গি, ব্যবহৃত শব্দ ও দোয়া- সব কিছুতেই ছিল গভীর ভালোবাসা, দয়া ও সহমর্মিতা। তাঁর এই সুন্নাহ আমাদের জন্য অনুসরণীয়। রাসুল (সা.) তাঁর কন্যাকে সান্ত¡না দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ যা দেন এবং যা নেন- সবই তাঁরই মালিকানা। আর প্রত্যেক জিনিসের জন্য তিনি একটি নির্ধারিত সময় বেঁধে রেখেছেন। সুতরাং তুমি আল্লাহর কাছে প্রতিদান আশা করো এবং ধৈর্য ধারণ করো।’ (বোখারি : ৭৩৭৭)।
লেখক : আলেম ও মাদরাসা শিক্ষক