ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নূরাল পাগলার দরবার: এক অস্থির অধ্যায়

নূরাল পাগলার দরবার: এক অস্থির অধ্যায়

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের জুড়ান মোল্লাপাড়ায় নূরাল পাগলার দরবার, একসময় যা ছিল ভক্ত-অনুসারীদের ভক্তি-আশ্রয়ের স্থান। কিন্তু অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে সেটিই পরিণত হলো উত্তেজনা, সংঘর্ষ ও সহিংসতার কেন্দ্রবিন্দুতে। কবর নির্মাণ থেকে শুরু করে মরদেহ উত্তোলন ও পোড়ানো, পুলিশের ওপর হামলা, গ্রেপ্তার, আদালতে জবানবন্দি—সবকিছু মিলিয়ে রাজবাড়ী জেলাজুড়ে এই ইস্যু এখন আলোচনার শীর্ষে।

জানা গেছে, ৮০ দশকে এই নূরাল পাগলা নিজেকে ইমাম মেহেদী দাবি করা, কালেমা ও আযান বিকৃত করে নিজের নামে পড়ার অভিযোগে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে জনতা। জনতার তোপের মুখে ওই সময় এলাকা ছেড়ে চলে যান তিনি। পরবর্তী সময়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে মুসলেকা দিয়ে তিনি পূনরায় এলাকায় ফিরে আসেন এবং পুনরায় তার কার্যক্রম শুরু করেন।

এ বিষয়টি মাঝে মধ্যেই জনতার মাঝে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি করলেও তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়নি ওই দরবার নিয়ে।

তবে গত ২৩ আগস্ট বার্ধক্যজনিত কারণে নূরুল হক ওরফে নূরাল পাগলা মারা যাওয়ার পর নতুন করে আলোচনা জন্ম দেয়। তার পরিবার ও ভক্তরা দরবারের ভেতরে সমতল ভূমি থেকে প্রায় ১০–১২ ফুট উঁচু একটি স্থাপনায় কবর দেন। শুধু কবরই দেননি, চারপাশ রঙ করে মক্কার কাবা শরিফের আদলে তৈরি করা হয়। পাশাপাশি দরবারে পূর্বের ইমাম মেহেদী লেখা একটি সাইনবোর্ডও দেওয়া হয়। এখান থেকেই শুরু হয় বিতর্ক।

স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এ নির্মাণকে ইসলামী আকিদার পরিপন্থী আখ্যা দেন। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে কবরের রঙ পরিবর্তন ও সাইনবোর্ড নামানো হয়। তবে কবর নিচু করার দাবি মানতে সময়ক্ষেপণ করে পরিবার।

৩ সেপ্টেম্বর রাজবাড়ী প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি আল্টিমেটাম দেয়। ৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দাবি না মানলে ৫ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ সমাবেশ এবং ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে না মানলে ১২ সেপ্টেম্বর মার্চ ফর গোয়ালন্দ-এর ঘোষণা দেওয়া হয়।

চাপে পড়ে ৫ সেপ্টেম্বর সকালে পরিবার কবর সমতল ভূমিতে নামায়। এদিন গোয়ালন্দ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ভক্তরা জানায়, আলেম-ওলামাদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সব দাবি মানা হয়েছে। জেলা জামায়াতের আমির অ্যাডভোকেট মো. নূরুল ইসলাম দরবার পরিদর্শন শেষে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং পরবর্তী কর্মসূচি স্থগিত করেন।

তবে ৫ সেপ্টেম্বর জুমার নামাজ শেষে তৌহিদি জনতার ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। একপর্যায়ে পুলিশ বাধা দিলে জনতা হামলা চালায়, গাড়ি ভাঙচুর করে। পরে দরবারে প্রবেশ করে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট চালানো হয়। এমনকি মরদেহ কবর থেকে তুলে মহাসড়কে এনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এসময় দরবারের ভক্ত রাসেল মোল্লা গুরুতর আহত হয়ে মারা যান। আহত হন পুলিশসহ ৫০ জনেরও বেশি।

এ ঘটনায় পুলিশ অজ্ঞাত ৩–৩.৫ হাজার জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে। ৬ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কয়েকজন আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। নিহত রাসেলের বাবার দায়ের করা আরেক মামলায়ও গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে।

ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে সিআইডি। ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. সিদ্দিকুর রহমান দরবার পরিদর্শন শেষে বলেন, ‘এই ঘটনায় জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। প্রশাসনের কেউ জড়িত থাকলেও না। তবে কোনো নিরপরাধকে হয়রানি করা হবে না।’

বর্তমানে দরবার এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। প্রবেশে কড়াকড়ি রয়েছে, মোতায়েন আছে অতিরিক্ত পুলিশ। স্থানীয়রা বলছেন, এ ঘটনা গোয়ালন্দের সামাজিক শান্তি ও ধর্মীয় সম্প্রীতি ভেঙে দিয়েছে।

কবর নির্মাণকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া বিরোধ সহিংসতায় রূপ নিয়ে মরদেহ পোড়ানো পর্যন্ত গড়িয়েছে। রাজবাড়ীর সাম্প্রতিক ইতিহাসে এটি এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে।

অস্থির অধ্যায়,নূরাল পাগলার দরবার
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত