ঢাকা সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান

কোরআনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনুপ্রেরণায় মুসলমানরা বিজ্ঞানের সব শাখায় জ্ঞানচর্চায় আত্মনিয়োগ করে ইতিহাসে অবদান রাখতে সক্ষম হন। মানুষ জানত, কথা বাতাসে হারিয়ে যায়; কিন্তু কোরআনের মাধ্যমে পাশ্চাত্য প্রথম জানল, মানুষের উৎক্ষিপ্ত কথা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এ কারণেই ড. মরিস বুকাইলি বলেন, ‘কোরআনে এমন কোনো বক্তব্য নেই, যে বক্তব্যকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিচারে খণ্ডন করা যেতে পারে।’ (বাইবেল, কোরআন ও বিজ্ঞান : ১২)। মুসলিমজাতি তাদের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ঘটিয়েছিল কোরআনের বদৌলতে। এটাই মুসলিমজাতির বিজ্ঞান উৎকর্ষ সাধনের মূল প্রাণশক্তি।

রসায়ন : মিশরে প্রথম রসায়ন চর্চা শুরু হয়। তারা কাঠ জোড়া দেওয়ার জন্য গদ আবিষ্কার করেন। গাছের আঠা, গম, আর যব ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করেন কাগজ। রসায়ন উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি করেছিল মুসলমানদের স্বর্ণযুগে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগ থেকে আলী (রা.)-এর হাত ধরে খালেদ বিন ইয়াজিদের সেতুবন্ধন হয়ে জাফর সাদেকের মাধ্যমে জাবির ইবনে হাইয়ানের হাতে মুসলিম রসায়ন বিজ্ঞানে পূর্ণতা লাভ করে। যখন মিশরীয়রা ও ইউরোপ রসায়নকে জাদুবিদ্যার প্রতীক মনে করত, তখন কুফায় হারুনুর রশিদের সময়কালে (৭৮৬-৮০৯) জাবির ইবনে হাইয়ানের গবেষণাগারে সোনা তৈরির ফরমূলার বাস্তবিক প্রয়োগ করে সোনার তাল উৎপাদন করেছিলেন। তিনি তার গবেষণাগারে গন্ধক ও পারদ আলাদা ধাতুতে পরিণত করেন। তার রচিত বিখ্যাত বইয়ে উল্লেখ করেছেন ধাতুসমূহ পারদ ও গন্ধকের সংমিশ্রণ ও সোনালি রঙের গন্ধকের সঙ্গে পারদের সংযুক্তিতে তৈরি হয় সোনা। তার বিখ্যাত রসায়নের গবেষণাগারে সীসাকে বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়ায় আবিষ্কৃত হয়। চতুর্দশ শতাব্দীতে মুসলমানদের হাত ধরে রসায়ন তার স্বর্ণযুগ অতিবাহিত করে। ঐতিহাসিক আমির আলি বলেন, ‘বিজ্ঞান হিসেবে রসায়ন প্রশ্নাতীতভাবে মুসলমানদের আবিষ্কার।’

পদার্থ বিজ্ঞান : আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সুরা নুরে মুসলিম পদার্থবিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এর অনুপ্রেরণায় আলোক বিজ্ঞানের পথ সুগম হয়। ভৌত বিজ্ঞানকে মুসলিম বিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক দর্শনের শিরোনামে আলোচনা করেছেন। ইবনে সিনা তার রচিত ‘শিফা ও ফান্না’ নামে পদার্থ বিজ্ঞানের আলোচনা করেছেন। পদার্থ বিজ্ঞানের একটি শাখায় ইবনুল হাইসামের নাম অবিস্মরণীয়। তিনি তার রচিত ‘মাকালাতু ফিজজুয়ে’ নামক গ্রন্থে আলোর প্রসরণ সম্পর্কে টলেমির ফরমুলার অসারতা প্রমাণ করেন। তিনি আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণের নিয়ম আবিষ্কার করেন।

চিকিৎসা বিজ্ঞান : চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রথম উদ্ভাবক হিসেবে ব্যাবিলনকে চিন্তা করা হয়। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষের প্রয়োজনে মানুষ জ্ঞানের এ শাখার প্রতি আকৃষ্ট। সভ্যতার চক্রবূহে ইউফ্রেটিস, তাইগ্রিস, মেসোপটেমিয়ার পরে চিকিৎসা বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে মিশরীয়রা। যুগ বদলের পালাক্রমে এ শাখা মুসলিম সভ্যতার ছোঁয়া পায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলমানদের আধ্মাত্যিক ও প্রায়োগিক চিকিৎসা আগেও সব সাফল্য ছাড়িয়ে মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের জয়জয়কার। রাসুলুল্লাহ (সা.) চিকিৎসা বিজ্ঞানকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। জনৈক জার্মান পন্ডিত অকপটে স্বীকার করেছেন, কোরআনের ১১৪ সুরার মধ্যে ৯৭টি সুরার ৩৫৫টি আয়াত সরাসরি চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর হাদিসের শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ বোখারির ‘তিব্বুন নবী’ শীর্ষক অধ্যায়ে ৮০টি পরিচ্ছেদ রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) তার জীবদ্দশায় যুদ্ধকালীন চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। খোলাফায়ে রাশেদার যুগে চক্ষু রোগের চিকিৎসা ইতিহাসখ্যাত। মুসলিম স্বর্ণযুগের বিজ্ঞানীরা যদি অনুবাদ না করতেন, তাহলে এ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান হয়তো আমরা পেতাম না। এনসাইক্লোপেডিয়া অব ব্রিটেনিকার নিবন্ধনকার আর আর ডাব্লিউর মতে, সপ্তম শতাব্দীতে মুসলিম চিকিৎসকদের মূল অভিযাত্রা শুরু হয়।

এ শতাব্দীর চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইয়াহইয়া নাহবি সর্বপ্রথম চিকিৎসা বিজ্ঞানে আরব মুসলমানদের অবদানের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জাবির ইবনে হাইয়ান প্রায় ৫০০টি চিকিৎসা সম্পৃক্ত বই রচনা করেন। তিনিই সর্বপ্রথম ব্যাবস্থাপত্রের ইতিবৃত্ত চালু করেন। ইতিহাসে তার রচিত ২২৬টি ব্যাবস্থাপত্রের সত্যতা পাওয়া যায়। নবম শতাব্দীতে স্পেনের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিদ ছিলেন আবুল কাসেম আজ-জাহরাবি। তিনিই ইউরোপের সর্বপ্রথম সার্জিকাল বিদ্যার প্রচলন ঘটিয়েছিলেন। ইবনে সিনা সর্বপ্রথম ফিজিওথেরাপির ধারণার সূত্রপাত ঘটান। টমাস ক্লিফোর্ড উল্লেখ করেন, ইবনে সিনার ‘কানুন’ হিপোক্রোটাস ও গ্যালোনের কৃতিত্বকে ম্লান করে দিয়েছে। মিশরীয় মুসলিম চিকিৎসক আবু হাসান আলি ইবনে নাফিস ফুসফুস গঠনতন্ত্রের আবিষ্কারক। তিনি তার আগের চিকিৎসকদের রক্ত চলাচলের মতামতের প্রতিবাদ করে নিজস্ব মতামত প্রতিষ্ঠা করেন।

সমর বিজ্ঞান : ইতিহাসে মুসলমানদের রণকৌশল অসমান্য অবদান রেখেছে। মহানবী (সা.)-এর যুগে বিভিন্ন অভিযানে অংশগ্রহণের জন্য সাহাবিরা বিশেষ রেজিস্ট্রি বইয়ে নাম লেখাতেন। সাহাবিরা প্রশিক্ষণের জন্য মানুুষ ও জন্তুদের মাঝে দৌড় প্রতিযোগিতা করাতেন। তীর ছুঁড়ে লক্ষ্যবস্তু ভেদ করার মতো প্রশিক্ষণের ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করতেন। যুদ্ধের স্থান নির্বাচন, দৃঢ় মনোবল, ব্যক্তিগত বীরত্ব, রণকৌশল ও যুদ্ধ পরবর্তী ব্যবহারে তারা যে রণনৈপুণ্যের প্রমাণ দিয়েছেন, তা আজও স্মরণীয়।

খোলাফায়ে রাশেদার আমলে সামরিক ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। আলী (রা.)-এর শাসনামলে মুসলিম জাহানের সৈন্যসংখ্যা ৯০ হাজার ছিল। ওমর (রা.) সামরিক বহিনীর যথাযথ পারিশ্রমিক নির্ধারণ ও বণ্টনের ভার দিওয়ানের ওপর অর্পণ করেন। খেলাফায়ে রাশেদার যুগে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল আধুনিক সমৃদ্ধশালী সামরিক ঘাঁটির। এ সময় মুসলিম সাম্রাজ্যে ৯টি সামরিক ঘাঁটি ছিল; যার প্রতিটি ঘাঁটিতে ৩৬ হাজার অশ্বারোহী সেনা প্রস্তুত থাকত। এ সময় মুসলিম সৈন্যরা দুর্গ অবরোধকারী যন্ত্রসহ সব ধরনের যুদ্ধাস্ত্রের ব্যাবহার শিখে ফেলে। উমাইয়া যুগে প্রথম ক্ষেপনাস্ত্রের সফল ব্যবহার দেখা যায়। উপমহাদেশে সিন্ধু উপকুলে মুহাম্মদ বিন কাসেম প্রথম অবরুদ্ধ দুর্গপ্রাচীর ভেঙে ফেলার জন্য মিনজানিক নামক কামান ব্যবহার করেন। ওসমান (রা.)-এর শাসনামলে মুআবিয়া (রা.)-এর নেতৃত্বে প্রথম মুসলিম নৌবাহিনী গঠিত হয়।

জ্যোতির্বিজ্ঞান : পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন সুরায় জ্যোতির্বিজ্ঞানের কথা রয়েছে। কোরআনে সৌরজগত ও গ্রহ-নক্ষত্রের গতি পরিক্রমা সম্পর্কে যে বিস্ময়কর তথ্য রয়েছে, তা ১৪০০ বছরের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মাথা নিচু করে মেনে নিয়েছে। বিখ্যাত মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানী আল-মাইমুন গ্রহের তির্যক গতি আবিষ্কার করেন। বায়ুমণ্ডলের পরিবর্তন সংক্রান্ত তথ্য আবিষ্কার করেন মহান জ্যোতির্বিদ আবুল হাসা। তিনি তার রচিত ‘সহিফায়ে জারকালিয়া’ বইয়ের মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে ব্যবহারিক পর্যায়ে নিয়ে যান। আল-ফারাবি প্রথম এ্যাস্ট্রোল্যাব আবিষ্কার করেন। মুহাম্মদ ইবনে মুসা এ্যাস্ট্রোল্যাব ও এ্যাস্ট্রোল্যাব তৈরির বিষয়ে দুটি গ্রন্থ লিখেন। জাবের ইবনে সিনান মান নির্ণয়ের যন্ত্র আবিষ্কার করেন। আলি ইবনে ঈসা আল-উস্তরলাবি সর্বনিম্ন দূরত্বের পরিমাপের যন্ত্র আবিষ্কার করেন।

গণিত বিজ্ঞান : পবিত্র কোরআনে সংখ্যা চর্চাবিষয়ক অনেক আয়াত রয়েছে। বিজ্ঞানের সব সূত্রপাত অংকশাস্ত্রের হাতেই আরম্ভ হয়। বিজ্ঞানে লা পিউরা ল্যাংগুয়েজ বলতে অংককেই বোঝানো হয়। ইসলামিক সায়েন্স গ্রন্থের লেখক সাইদ হোসেন নাজি ইখওয়ানুস-সাফার গাণিতিক মতবাদ প্রসঙ্গে লিখেছেন, সংখ্যা বিজ্ঞান বিজ্ঞানসমূহের বুনিয়াদ, প্রথম স্পর্শমণি ও মহান রসায়ন। খলিফা ওমর (রা.)-এর সময়ে তিনি হিজরিসন চালু করে শাসন ও রাজত্বব্যবস্থা সুদৃঢ় করেন। এরপরই মুসলমানরা আরবি অক্ষরগুলোকে ‘আবজাদ’ সংখ্যামালার গণনা অনুযায়ী ব্যবহার শুরু করে। আব্বাসীয় খলিফা আবু জাফর আল-মানসুরের রাজত্বকালে আবু ইসহাক আল-ফাজারি সর্বপ্রথম সমুদ্রে সূর্য ও নক্ষত্রসমূহের উচ্চতা নির্ণায়ক যন্ত্র আস্তারলব নির্মাণ করেন। অংকশাস্ত্রেও অন্যান্য যন্ত্রপাতি সম্বন্ধে বই লিখেন। আল-ফাজারি প্রথম আরব গণনাপদ্ধতি সুনিয়ন্ত্রিত করে আরব বর্ষগণনা ও দিনপঞ্জী প্রণয়ন করেন। আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খারেজমি গণিত বিজ্ঞানের একজন কালজয়ী প্রতিভা। তিনিই সর্বপ্রথম বীজগণিতকে অংকশাস্ত্রের মর্যাদা দেন। এজন্যই তাকে আধুনিক বীজগণিতের জনক বলা হয়। তিনি একাধারে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও অন্যদিকে অংক ও বীজগণিতের আবিষ্কারক। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল-জাবর ওয়াল মুকাবিলা’ ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অংকশাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ পাঠ্যপুস্তক ছিল।

এ গ্রন্থে তিনি ৮০০ উদাহরণের মাধ্যমে সমীকরণের জটিল সব সমস্যার সমাধান করেন। তিনিই সর্বপ্রথম আরব সংখ্যারীতি বীজগণিতে প্রবর্তন করেন। ঐতিহাসিক পিকে হিট্টির মতে, ত্রিকোণমিতির বিজ্ঞান, যেমন- বীজগণিত ও জ্যামিতি প্রধানত আরবদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বীজগণিতের অন্যতম যে অংশ লগারিদম আজ আমরা দেখতে পাই, তা আল-খারেজিমি নাম থেকেই উদ্ভুত। আল-খারেজিমি আল-জাম ওয়াত-তাফরিক গ্রন্থে সংখ্যার উৎপত্তি নিয়ে আলোচনা করেন। আরব বৈজ্ঞানিকরা অংক সংখ্যা লেখার ক্ষেত্রে ‘শূন্য’ ব্যবহারের নিয়মপদ্ধতির আবিষ্কারক। শূন্য আবিষ্কারের আগে মানুষ এবাকাস ব্যবহার করত। দশম শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুসলিম বৈজ্ঞানিক আবুল ওয়াফা ত্রিকোণমিতির তালিকা প্রণয়ন করেন। তিনিই সর্বপ্রথম সাইন উপপাদ্যের সঙ্গে গোলাকার ত্রিভূজের সাধারণত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। কবি ওমর খৈয়াম (১০২১-১১২৩) অনেক উঁচু মাপের গণিতবিদ ও বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। ওমর খৈয়ামই প্রথম কণিকের ছেদ দ্বারা এর দ্বিঘাত, ত্রিঘাত ও ঘন সমীকরণগুলোর সমাধান বের করেন।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমকর্মী

বিজ্ঞান,মুসলমান
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত