বিনোদ স্যার বাড়িতে আসা মানেই জমিয়ে গল্প করা। দুর্দান্ত গল্প বলতে পারেন স্যার। আমাদের স্কুলে অঙ্ক করান বিনোদ স্যার। সায়েন্সে স্যারের অগাধ বিশ্বাস। অবাক বিষয় হলো স্যার সায়েন্সের মানুষ হয়েও ভূত-প্রেতেও বিশ্বাস করেন। স্যার নাকি সত্যি সত্যি ভূত দেখেছেন কয়েক বার! স্যারের যুক্তি হলো, আমি যেহেতু ভূত নিজের চোখে দেখেছি তখন বিজ্ঞানের কথা মানার কোনো প্রশ্নই আসে না। প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে হয়। যদি আমরা জানতে চাইতাম, ভূত দেখতে কেমন? স্যার, রহস্যের হাসি দিয়ে বলতেন, ওসব বলতে নেই রে! রাত-বিরাতে বাইরে বেরুতে পারবি না! বিনোদ স্যার বাবার বন্ধু মানুষ। পেটের ভেতর বিস্তর গল্পের ঝুড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ান। ঢেঁকুর তুললেই গল্প বেরিয়ে আসে। হাড় হিম করা সব গল্প। ভূতের গল্প বলতে স্যারের জুড়ি নেই। আমরা জানি সেসব ঘটনার কোনোটাই সত্যি না। এসব ঘটনা সত্যি হতেই পারে না। স্যারও কোনোদিন ভূত দেখেননি। কিন্তু স্যার এমনভাবে গল্প বলেন যে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মনে হয় সব ঘটনাই সত্যি। এটাই স্যারের গল্প বলার বিশেষত্ব। স্যার মাঝে মধ্যে সন্ধ্যায় এসে আমাদের দুই ভাই-বোনোর কাছে বলে পেটটা হালকা করেন। সঙ্গে চা-মুড়ি চলে। বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই! কোনোদিন বাবাও উপস্থিত থাকেন গল্পের আসরে। আমরা চাই না বাবা থাক আমাদের সঙ্গে। বাবা উপস্থিত থাকলে গল্প শোনাই বৃথা! পুরো গল্পের সময় বাবা কোনো কথা বলেন না। সরু চোখ করে তাকিয়ে থাকেন। মাঝে মধ্যে হু হা টাইপের শব্দ করেন। ভাব করেন যেন তিনি গল্পটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। আসলে ঘটনা অন্য! গল্পের শেষে বাবা গল্পের এমন অংশ খুঁজে বের করেন যে স্যার যে গল্পটা বানিয়ে বলেছেন সেটা ধরা পরে যায়। স্যার তখন আর বসতে চান না। তাড়াহুড়ো করে উঠে যান। গল্পের শেষে যদি জানা যায় এটা মিথ্যা গল্প তখন আর গল্পের মজা থাকে! বাবা এই কাজটাই করেন। বিশ্রী লাগে। আজ বাবা দুপুরেই বলে রেখেছেন বিনোদ স্যার আসবেন। তার নাকি জীবনের একটা ভয়ঙ্কর গল্প মনে পরেছে। আমরা তো মহাখুশি। কারণ সেদিন সন্ধ্যায় পড়তে হবে না। চা-মুড়ির সঙ্গে গল্প শোনা ফ্রি। এরপর আর কিছু লাগে নাকি! আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি গল্প শোনার। সন্ধ্যা পার হয়েছে। ওদিকে আকাশের কালো মেঘ জানান দিচ্ছে যেকোনো সময় পৃথিবী ভাসিয়ে দিবে।
এ কারণেই মনটা একটু খারাপ। আষাঢ় মাস। যে কোনো সময় তো বৃষ্টি নামতেই পারে। এই মাসে সেই পারমিশান আছে! কিন্তু বৃষ্টি এলে তো আর গল্প শোনা হবে না! এসব যখন ভাবছি তখনই বাইরের গেটে বিনোদ স্যারের ভারি গলা। আমি দৌড়ে গিয়ে গেট খুলে দিলাম। স্যার ভেতরে আসা মাত্রই সত্যি সত্যি আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। আমাদের চা এর আড্ডাও শুরু হলো। খারাপ ব্যাপার হলো বাবা আর বৃষ্টির জন্য বাইরে গেলেন না। আমাদের গল্পের আসরে যোগ দিলেন। স্যার শুরুতেই জানতে চাইলো, কি রে তোরা কি ধরনের গল্প শুনতে চাস? আমরা তো এক বাক্যে বললাম, স্যার যে ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প বলতে চাইছিলেন সেটা বলেন। বাইরে বৃষ্টি। কারেন্টটাও চলে গেছে। কেমন একটা ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়েছে। দারুণ একটা সময়। ‘তোদের কিন্তু ভয় লাগবে?’ ভয়ে কাঠ হয়ে যেতে পারিস! রাতে বাথরুম চাপলেও কিন্তু আটকে রাখতে হবে! তাও শুনবি? আমরা সম্মতি দেই। বলতেই হবে। বাবা সরু চোখে তাকিয়ে আছেন স্যারের দিকে। স্যার শুরুতে এভাবেই ভুতের গল্প থেকে মন ফেরাতে চান। যদিও আমরা জানি তিনি শেষমেশ গল্পটা বলবেন। আমাদের মনের ইচ্ছেটা পরীক্ষা করছেন। আমরাও গোঁ ধরে বসে রইলাম। সেই গল্পই বলতে হবে। স্যার শুরু করলেন।’ শোন, আমি যেবার এসএসসি পরীক্ষা দেই সেটা নাইনটিন নাইনটি নাইন। বুঝলি তো?’ স্যার এক মনে গল্প বলে চললেন। গল্প শেষ হলো। কখন যে বৃষ্টি ছেড়ে গেছে টেরই পাইনি। আমরা তখনও পরে আছি স্যারের নাইনটিন নাইনটি নাইনে। বাবা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন।
স্যার বললেন, আজকে আমি যাই রে। তোরা আবার সাবধানে থাকিস। গল্পটা তো ভয়ঙ্কর! রাতে ভয় পেতে পারিস। স্যারকে এগিয়ে দিয়ে গেট বন্ধ করে ঘরে এলাম। এবার এক অদ্ভূত কাণ্ড ঘটলো। বাইরের দরজায় আবার কড়া নাড়ার শব্দ। স্যার কি তবে কিছু ফেলে গেছেন? সেটা নিতে এসেছেন? আমি এগিয়ে যাই। আমি গেট খুলে হা করে তাকিয়ে রইলাম। বাইরে বিনোদ স্যার ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখটা হাসি হাসি। এইমাত্র তো স্যারের হাতে ছাতা ছিল না। স্যারের শরীরের পোশাকটাও ভিন্ন। তাছাড়া স্যার আবার আসবেন কেন? এসব যখন মনের ভেতর উঁকি দিচ্ছে তখন স্যার মুচকি হেসে বললেন, আসলে বৃষ্টির জন্য সন্ধ্যায় আসতে পারিনি রে। এমন বৃষ্টি নামলো যে আটকে গেলাম। তোদের আজ আর আমার ভয়ঙ্কর গল্পটা বলা হলো না। চল, ভেতর থেকে চা, মুড়ি খেয়ে বিদায় হই। বলতে বলতে স্যার ভিতরে ঢুকে যান। আমি তখনও গেট ধরে দাড়িয়ে আছি।