নওগাঁয় ন্যায্য মূল্য পেতে আলু সংরক্ষণে অহিমায়িত মডেল ঘর কৃষকদের দেওয়া হয়েছে যা কোনো কাজে আসছে না। বরং এ মডেল ঘরে আলু রাখায় তা পঁচে নষ্ট হওয়ায় কৃষকরা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এতে কৃষকদের লোকসানে পড়তে হয়েছে। সরকারের এ প্রকল্পটি জলে যাওয়ার উপক্রম বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে- জেলায় এ বছর ২৫৯৪০ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। যা থেকে প্রায় ৫ লাখ টন উৎপাদন হয়েছে। জেলায় ৭টি হিমাগারে ধারণক্ষমতা ৪৬৫৩০ টন। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃদ্ধ আলু বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। ভালো দাম পাওয়ার আশায় এ বছর আলু চাষিরা আশায় বুক বেঁধে চাষাবাদ করেছিল। যেখানে উন্নত জাতের ডায়মন্ড, স্টিক ও কাটিনাল চাষ করে ভালো ফলন হলেও হিমাগার স্বল্পতায় অনেক কৃষক আলু সংরক্ষণ করতে পারেনি। আবার উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় ন্যায্য দাম না পাওয়ায় লোকসান গুণতে হচ্ছে। তবে আলু চাষিদের ন্যায্য মূল্য পেতে ‘আলুর বহুমুখী ব্যবহার, সংরক্ষণ ও বিপণন উন্নয়ন প্রকল্প’ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলু সংরক্ষণে ৩৬টি অহিমায়িত মডেল ঘর দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ঘর ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হয়েছে। ঘরটি দেশীয় প্রযুক্তিতে বাঁশ, কাঠ, টিন ও আরসিসি পিলার এবং কর্কশিট দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে ১০-১৫ জন কৃষক ২৫-৩০ টন আলু মার্চ থেকে জুন (৪ মাস) পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখতে পারবেন। পাশাপাশি রসুন, পেঁয়াজ ও মিষ্টি কুমড়া সংরক্ষণ করা সম্ভব।
কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে নির্জন স্থানে ঘরটি তৈরি করা হয়েছে। নিরাপত্তার অভাব থাকায় অনেক কৃষক সেখানে আলু রাখতে চান না। আবার পঁচে নষ্ট হওয়ার শঙ্কা থেকেও অনেকে আলু রাখতে চান না। অনেক ঘরে আলু না রেখে খড়ি রাখার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার অনেকে ব্যবসার কাজেও আলু রাখছেন। প্রকল্প থেকে মডেল ঘরটি তৈরি হওয়ার পর থেকে অধিকাংশ ঘরই এখন পড়ে রয়েছে। মোট কথা ঘরটি কৃষকদের কোনো কাজেই আসছে না। প্রকল্পটির লাখ লাখ টাকা জলে যাওয়ার উপক্রম।
কৃষকরা জানান- এ বছর আলু চাষে বীজ, সার, শ্রমিক ও কীটনাশক ও আনুষঙ্গিক মিলে বিঘাপ্রতি খরচ হয়েছে অন্তত ৩৫-৩৬ হাজার টাকা। যা গত বছরের তুলনায় ৫-৬ হাজার টাকা বেশি। এ বছর উৎপাদন খরচ বেশি হলেও ন্যায্য দাম না পাওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে। লাভের আশায় মডেল এ ঘরে আলু সংরক্ষণ করে পঁচে নষ্ট হওয়ায় এখন মরার ওপর খড়ার ঘা।
জেলার বদলগাছী উপজেলার কোলা গ্রামের কৃষক সানোয়ার হোসেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রকল্প থেকে আলু সংরক্ষণের অহিমায়িত মডেল ঘর পেয়েছেন। দলনেতা হিসেবে তিনি এ ঘরের দায়িত্বে রয়েছেন। এ বছর তিনিসহ ৩ জন কৃষক মিলে ৩০০ মন কাটিনাল ও ডায়মন্ড জাতের আলু সংরক্ষণ করেছিলেন।
কৃষক সানোয়ার হোসেন বলেন, মডেল ঘরটিতে আলু সংরক্ষণের আগে জমিতে আলু পরিপক্ক করে নেওয়া হয়েছিল। এরপর ভালোভাবে বাছাই ও পরিষ্কার করে শুকিয়ে নিয়ে মার্চ মাসে সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে ভালো দাম পেলে বাজারে বিক্রি করা হবে। কিন্তু সংরক্ষণের ৩ মাসের মধ্যে প্রায় ১০০ মণ আলু পঁচে নষ্ট হয়ে যায়। এতে বর্তমান বাজার মূল্যে প্রায় ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। একই গ্রামের কৃষক আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, দেড় বিঘা জমিতে ডায়মন্ড ও কাটিনাল জাতের আলু রোপণ করেছিলাম। যার ১৩০ মণ আলুর পুরোটাই এ মডেল ঘরে সংরক্ষণ করেছিলাম। কাটিনাল আলু পুরোটাই নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে এ ঘর আর আলু আর রাখবো না। কৃষক সোহেল রানা বলেন, হিমাগারে আলু রাখতে বস্তাপ্রতি কমপক্ষে ৫০০-৫৫০ টাকা খরচ হতো।
এছাড়া একটা নির্দিষ্ট সময় পর আলু বের করা হয়। আবার হিমাগারে জায়গাও পাওয়া যায় না। আর সরকার যে মডেল ঘরটি কৃষকদের সুবিধার জন্য দিয়েছে সেখানে সংরক্ষণ করে যে কোনো সময় ভালো দাম পেলে বিক্রি করা হবে। কিন্তু আলু পঁচে নষ্ট হওয়ায় উল্টো কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হলো। সরকারের প্রকল্পটি অপরিকল্পিত মনে হয়েছে। যেখানে লাখ লাখ টাকায় তৈরি ঘর জলে যাওয়ার মতো অবস্থা।
সদর উপজেলার হুগলবাড়ী গ্রামের কৃষক মামুন বলেন, মডেল ঘরটি গত দুই বছর আগে একটি নির্জন স্থানে তৈরি করা হয়েছে। নিরাপত্তার অভাব থাকায় সেখানে আমরা আলু রাখতে আগ্রহী না। আবার পঁচে নষ্ট হওয়ার শঙ্কা থেকেও অনেকে আলু রাখতে আগ্রহী না। তবে শুরুতে আমাদের নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল কিভাবে আলুগুলো মডেল ঘরটিতে সংরক্ষণ করা হবে। এখন কোনো কিছুই কাজে আসছে না। সদর উপজেলার তিলোকপুর ইউনিয়নের ওয়ার্ড মেম্বার জাহিদুল ইসলাম রিংকু। এ ইউনিয়নের ডাকাহার গ্রামে তার নামে একটি ঘর বরাদ্দ রয়েছে। তিনি বলেন, ১৫ জন কৃষক মিলে একটি দল গঠন করা হয়। যারা সবাই মিলে আলু রাখতে পারবো। প্রথম বছর প্রায় ২০ দিন আলু সংরক্ষণ করে প্রায় ৩৬ হাজার টাকা লাভ করেছিলাম। এ বছর ৩০০ মন আলু কিনে সংরক্ষণ করা হয়। কিছু আলু নষ্ট হয়েছে। ১০০ মণ বিক্রি করা হয়েছে। দাম কম থাকায় বিক্রি করা হচ্ছে না। আবার নিরাপত্তা ও পঁচে যাওয়ার শঙ্কায় অনেকে আলু রাখতে চাই না। নওগাঁ জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা সোহাগ সরকার বলেন, সংরক্ষণের অভাবে কৃষক পর্যায়ে অনেক আলু পঁচে নষ্ট হয়ে যায়। আলু সংরক্ষণে জেলায় ৩৬টি অহিমায়িত মডেল ঘর কৃষকদের দেওয়া হয়েছে। যেখানে আলু সংরক্ষণ করে রাখাসহ যেকোন সময় বিক্রি করে কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবেন। এ ঘরে আলু রাখলে হিমাগারে যে খরচ হতো তা থেকে সাশ্রয় হতে পারেন। প্রায় সব ঘরেই কৃষকরা আলু সংরক্ষণ করেছেন। তবে দুই, একজন কৃষক হয়তো ব্যক্তিগত কারণে রাখেননি বা ভালো দাম পেয়ে আলু বিক্রি করে দিয়েছেন।