ঢাকা শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সবার কণ্ঠে নতুন বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় অঙ্গীকার

ফ্যাসিবাদমুক্ত নববর্ষ উদযাপন
সবার কণ্ঠে নতুন বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় অঙ্গীকার

নতুন আমেজে, নতুন আঙ্গিকে আনন্দ-উল্লাস, উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে ফ্যাসিস্টমুক্ত বাংলাদেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়েছে। বাংলা নতুন বছরকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) টিএসসি এলাকাসহ রাজধানীজুড়ে বর্ষবরণের আনন্দে মেতে ওঠেন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নানা শ্রেণির মানুষ। সবার কণ্ঠে নতুন বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় অঙ্গীকার।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এবারের নববর্ষে অন্যতম আকর্ষণ ছিল ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’। এছাড়াও বিভিন্ন মোটিফ, বাংলার ঐতিহ্যবাহী মুখোশ, মাটির হাঁড়ি, শীতল পাটি, খেলনা এবং হাত পাখা পহেলা বৈশাখের উৎসব প্রাণবন্তর করে তোলে। ঢাকায় রমনার বটমূল থেকে চারুকলা-শাহবাগ, শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হয় বৈশাখের অনুষ্ঠান। আনন্দ শোভাযাত্রা, লোকজ সংস্কৃতি, নাচণ্ডগান-আবৃত্তি সবই ছিল নববর্ষের আয়োজনে। ঢাকার ছোট-বড় অনেক আবাসিক ভবনের বাসিন্দারা নিজেদের মতো করে আয়োজন করেন নানা অনুষ্ঠান। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত এসব উৎসবে মানুষের পদচারণ ছিল। পুরোনো ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলে সবার কল্যাণ কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষের এসব উৎসব।

টিএসসি চত্বরে পহেলা বৈশাখের উৎসব উপলক্ষে এসেছিলেন শাকিল মাহমুদ, সালেহ আহম্মেদ, কাজী রফিকুল ইসলাম ও লায়লা খাতুন। তারা বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বিগত সময়ে পহেলা বৈশাখের উৎসব রাজনীতিকরণ করা হয়েছিল। বাঙালি সাংস্কৃতি নষ্ট করে রাজনীতিকরণ করা হয়। রাজনৈতিক সংকটের কারণে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মুখে পড়েছিল। আওয়ামী লীগের মতাদর্শের বাইরে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ পহেলা বৈশাখ উদযাপনে শাহবাগ ও টিএসসিতে আসতে ভয় পান। এই উৎসবও কখনো সংকুচিত হয়েছে, কখনো হয়ে উঠেছে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতীক। যেন তা আটকে ছিল কিছু নির্দিষ্ট বলয়ে, একটি দল বা ঘরানার নিজস্ব আয়োজন হিসেবে। এবারের বৈশাখ সেই নীরব অবরোধ ভেঙে দিয়েছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর এবার নতুন পরিবেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়েছে। ফলে এবারের উৎসবের আয়োজনে কিছুটা ব্যতিক্রমও ছিল। প্রতিবারের মতো এবারও রাজধানীর বর্ষবরণের অন্যতম বর্ণাঢ্য আয়োজন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শোভাযাত্রা। নেচেগেয়ে হাজারো মানুষ অংশ নেন ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’য়। পহেলা বৈশাখের এই বর্ণিল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ছিল ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার আয়োজনে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’য় অংশ নিয়ে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছেন, এবারের নববর্ষের শোভাযাত্রা রাজনৈতিক নয়। শুধু ফ্যাসিস্টের মুখাবয়ব ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ, ফ্যাসিস্ট কোনো রাজনীতির অংশ নয়। ফ্যাসিস্ট সবচেয়ে বড় অশুভ শক্তি।

পহেলা বৈশাখে আয়োজন : রমনার বটমূলে বর্ষবরণের ঐতিহ্যবাহী অন্যতম প্রধান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ছায়ানট। আলোর পথযাত্রার আহ্বান জানিয়ে সুরে ও বাণীতে বাংলা ১৪৩২ সনকে বরণ করে নেয় ছায়ানট। ছায়ানটের এবারের আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। দেশ, মানুষ, প্রকৃতিকে ভালোবাসার গান ও পাঠ দিয়ে সাজানো হয়েছিল ছায়ানটের অনুষ্ঠান। জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আয়োজন করা হয় কনসার্ট। বর্ষবরণ উপলক্ষে এই কনসার্ট ও ড্রোন শোর আয়োজন করে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এছাড়াও চ্যানেল আই-সুরের ধারা আয়োজিত ১৪৩২ বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হয় রাতের আঁধার কেটে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে। রাজধানীর ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরের উন্মুক্ত চত্বরে যেন প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়েই শুরু হয়েছিল নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর সূচনা। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের তিন শিল্পীর সরোদের সুরে সুরে বরণ করে নেয়া হয় বাংলা নতুন বছর ১৪৩২। দেশাত্মবোধক গান, রবীন্দ্রসংগীত, লোকগীতিসহ ছিল পঞ্চকবির গান। গুলশানে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন পার্কে নববর্ষের উৎসবের আয়োজন করে গুলশান সোসাইটি ও অলিগলি বন্ধু। বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এবারের শোভাযাত্রায় ২৮টি জাতিগোষ্ঠী, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন দেশের অতিথিরা অংশ করেন।

‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতিতে’ আগুন : গত শনিবার ভোরে চারুকলা অনুষদের ভেতরে শোভাযাত্রার জন্য তৈরি করা দুটি মোটিফে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে ২০ ফুট উচ্চতার ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি নামের মোটিফটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। তার পাশেই রাখা ‘শান্তির পায়রা’ মোটিফের একটি ডানা ও লেজের খানিকটা পুড়ে যায়। ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি মোটিফটি বাঁশ ও বেত দিয়ে দাঁতাল মুখের এক নারীর মুখাবয়ব বানানো হয়। মাথায় খাড়া চারটি শিং, হাঁ করা মুখ, বিশালাকৃতির নাক ও ভয়ার্ত দুটি চোখ। এটিকে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি হিসেবে ধারণা করেছিলেন অনেকে।

গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর আমূল পরিবর্তন ঘটেছে দেশের রাজনীতিতে। জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এবারই প্রথম পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকায় এবং সব শ্রেণি-পেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেন আনন্দ শোভাযাত্রায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মাইনুল ইসলাম বলেন, ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করে আনন্দ শোভাযাত্রা করাকে স্বাগত জানাই। ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশে এই আনন্দ শোভাযাত্রা সব বিভাজন পেরিয়ে সমতা, মানবিকতা আর প্রতিবাদী চেতনাকে ধারণ করছে।

কেমন ছিল ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’: গত সোমবার সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হওয়া ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’য় হাজারো উচ্ছ্বসিত মানুষ অংশগ্রহণ করেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আনন্দ শোভাযাত্রাটি চারুকলা অনুষদে গিয়ে পুনরায় শেষ হয়। শোভাযাত্রাটি চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় ঘুরে টিএসসি মোড়, শহিদ মিনার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, দোয়েল চত্বর হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তা দিয়ে পুনরায় চারুকলা অনুষদে গিয়ে শেষ হয়। দেশের মানুষের পাশাপাশি শোভাযাত্রায় বিদেশিরাও অংশ নেন। শোভাযাত্রাকে ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরব উপস্থিতি ছিল।

আনন্দ শোভাযাত্রায় উচ্ছ্বসিত ছিল বিদেশিরা : পহেলা বৈশাখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকায় বিদেশিরা আনন্দ শোভাযাত্রা অংশ নেন। রং-বেরংয়ের পোশাক, ঢাক-ঢোল আর নানান বাদ্যযন্ত্রের তালে চলছে বাংলা নববর্ষের আনন্দ শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’য় শুধু দেশি নয়, নেচে-গেয়ে উৎসবে মেতে উঠেছেন একঝাঁক বিদেশি শিক্ষার্থী ও পর্যটক। চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে শোভাযাত্রায় জাপান, ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানিসহ নানা দেশের পর্যটক অংশগ্রহণ করেন। শোভাযাত্রায় আসা রাশিয়ার একজন নাগরিক বললেন, এটি আমার জীবনের সেরা কালচারাল এক্সপেরিয়েন্স। সব কিছু অসাধারণ। শুভ নববর্ষ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত