অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত জাতীয় ঐকমত্যের কমিশনের সংলাপে অনৈক্য বাড়ছে। কমিশনের গত মঙ্গলবারের সংলাপে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী অংশ না নিলেও গতকাল দ্বিতীয় পর্যায়ের তৃতীয় বৈঠকে যোগ দেয়। সংলাপে কোনো দলের প্রতিনিধিদের বেশি সময় ধরে বক্তব্যের সুযোগ করে দেওয়া এবং কিছু দলের প্রতিনিধি বক্তব্য দিতে গেলে বাধাগ্রস্ত করা হয়। যার কারণে কমিশনের সংলাপে হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। সেই হট্টগোলের মাঝে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ড. মিজানুর রহমান এবং ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক শাহাদাত হোসেন সেলিম কমিশনের বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসেন। তবে, কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে ঐকমত্য কমিশনের আশ্বাসে বৈঠকে যোগ দেন। সংলাপে অংশ নেয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, নাগরিক ঐক্য, সিপিবি, এবি পার্টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলনসহ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা। বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব করেন নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রতিনিধিত্ব করেন আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক হয়। বৈঠকের বিষয়ে রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, বৈঠকে বৈষম্য হয়েছে। জামায়াতের তিনজন বলেছে, আমাদের একজন বললেও বাধাগ্রস্ত করেছে। এ বিষয়ে মিজানুর রহমান এবং শাহাদাত হোসেন সেলিমসহ আমরা প্রতিবাদ করেছি। ঐকমত্য কমিশন এটা নোট করায় ফের সংলাপে যোগ দেন রুহিন হোসেন প্রিন্স। শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, আমরা যখন কথা বলেছি, তখন আমাদের থামিয়ে দেওয়া হয়। জামায়াতে ইসলামী অপ্রাসঙ্গিক কথা বলছিল। তখন আমি বললাম, এটা প্রাসঙ্গিক নয়। তখন তিনি বলেছেন, আপনি কতজন লোককে প্রতিনিধিত্ব করেন।
বিএনপি : জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার সংলাপের বিরতিতে সাংবাদিকদের সামনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, আগামী মাসের মধ্যে জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করে নতুন গন্তব্যে পৌঁছে দেশে শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় বিএনপি। এ দিন সংলাপ যতটুকু হয়েছে তাতে বিএনপি সন্তুষ্ট কী না জানতে চাইলে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘সন্তুষ্ট কী না সেটা আলোচনার পরে বলা যাবে, তবে আমরা চাই সংস্কারের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের নতুন গন্তব্যে পৌঁছে শক্তিশালী গণতন্ত্র যেন আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারি। একটা জায়গায় এসে সংস্কারের বিষয়গুলো সমাপ্ত করতে পারি এবং জুলাইয়ের মধ্যে যেন জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হতে পারে।’ সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে দুই বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। সেই দুইটা হচ্ছে আস্থা ভোট ও অর্থ বিল। এই দুইটা বিষয় বাদে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে। এই দুই বিষয়ে তারা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে না। আরও কয়েকটি দল তার সঙ্গে সংবিধান সংশোধনী বিল যুক্ত করেছে। এছাড়া জাতীয় সনদে সবার স্বাক্ষর থাকবে। তিনি বলেন, ‘সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসা গেছে। পাবলিক একাউন্টস কমিটি, প্রিভিলেজ কমিটি, পাবলিক আন্ডার টেকিং কমিটিসহ আরও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে সভাপতির পদ আসনের ভিত্তিতে বিরোধীদল প্রাপ্ত হবেন। নারীদের সংরক্ষিত ১০০ আসন রাখার বিষয়ে সবাই একমত। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা চলছে। সেটা এখনও চলমান।’
জামায়াতে ইসলামী : অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ফোন করে ‘নিরপেক্ষ থাকবেন বলে আস্বস্ত করায়’ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে যোগ দিয়েছে বলে জানান দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। পাশাপাশি ইউনূস নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশন এখন ইফ, যদিতে আছে, কিন্তুতে যাবে কি না আল্লায় জানে। ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, বিদেশের মাটিতে একটি দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে সরকার প্রধানের এমন বৈঠক পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। এতে আমরাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিব্রত। এ কারণেই ঐকমত্য কমিশনের গত মঙ্গলবারের বৈঠকে আমরা অংশগ্রহণ করিনি। তবে প্রধান উপদেষ্টাসহ কমিশনের অনুরোধে গতকালের বৈঠকে আসে জামায়াত।
কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের তৃতীয় দিনের সংলাপের বিরতিতে সাংবাদিকদের সামনে ডা. তাহের বলেন, বিভিন্ন দেশে সরকারের সঙ্গে প্রধান বিরোধীদল বা সংসদের প্রতিনিধিত্বকারীদের সঙ্গে যৌথ বিবৃতি হয়। দেশে শতাধিক দল আছে। তাহলে তো এমন একটি সংস্কৃতি তৈরি হবে, প্রধান উপদেষ্টা যার সঙ্গে কথা বলবেন, একটা যৌথ বিবৃতি দিতে হবে। এতে অন্যান্য দল বিব্রত হয়েছে। তবে বিএনপির ব্যাপারে জামায়াতের বক্তব্য নেই। তিনি বলেন, প্রথমত সাংবিধানিক কাউন্সিলের পক্ষে জামায়াত। তবে এর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির সম্পৃক্ততা চাই না। কারণ তারা দুই জনই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকেন। তাছাড়াও কোনো বিষয়ে বিরোধ হলে সমাধান করবেন কে? তাই সেখানে প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা ও স্পিকার থাকবেন। নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে অনিশ্চয়তা নেই- স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর এ বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছে জামায়াত। এছাড়া মেয়র পদের জন্য নগর ভবন তালাবদ্ধ করে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের আন্দোলনের প্রতি ইঙ্গিত করে ডা. তাহের বলেন, যিনি একমাসেও একটি ভবনের তালা খুলতে পারেন না, ৩০০ সংসদীয় আসনের কীভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবেন, সেটাও বিস্ময়ের ব্যাপার। আমি ওনাকে সংযতভাবে কথা বলার অনুরোধ করছি। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কী হবে, এটা বুঝার জন্য অনুরোধ করছি।
এনসিপি : ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের বিরতিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘কয়েকটি রাজনৈতিক দল জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের বিপক্ষে মতামত দিয়েছে। আমরা বলতে চাই, যারা এনসিসি গঠনের বিপক্ষে, তারা মূলত ফ্যাসীবাদী কাঠামোয় থেকে যেতে চান। তার দল এনসিসি গঠনের প্রস্তাবকে সমর্থন জানায়। তবে গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের দ্বিমত রয়েছে। যারা এনসিসি গঠনের বিরোধিতা করছেন, তাদের বিকল্প প্রস্তাব পেশ করার আহ্বান জানিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা জানতে চাই, আপনারা কি আগের ফ্যাসিবাদী কাঠামোয় থেকে যেতে চান? মানবাধিকার কমিশন থাকার পরও বিগত ১৬ বছরে তারা কোনো কথা বলেনি। দুদক ও নির্বাচন কমিশন তাদের কার্যক্রমে বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। কারণ, তারা একটি দল ও ব্যাক্তির আজ্ঞাবহে পরিণত হয়েছিল।’ এনসিপির এই নেতা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে এনসিসি গঠনের বিষয়ে মতামত দেওয়ার আহ্বান জানান। এনসিসি গঠনকে ক্ষমতার ভারসাম্য হিসেবে উল্লেখ করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘নির্বাহী বিভাগের অসম ক্ষমতা হ্রাস করতেই আমাদের নতুন বাংলাদেশের যাত্রা। তাই আমরা এনসিসি গঠনের পক্ষে মত দিয়েছি। তবে এখানে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান নিয়োগের ক্ষমতা থাকা উচিত নয়। পাশাপাশি এনসিসিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিকে রাখা উচিত নয়। এটা নিয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে।’
হাতে হাত রাখলেন সালাহউদ্দিন তাহের ও নাহিদ : জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ চলাকালে বিরতির সময়ে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের হাতে হাত রেখে পরস্পর সৌহার্দ্যরে বার্তা দিয়েছেন।
এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের গতকালের সংলাপের সূচি ছিল অসমাপ্ত আলোচনা শেষ করা, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি), জেলা সমন্বয় কাউন্সিল প্রস্তাব, ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। সংলাপে সব রাজনৈতিক দল অংশ নেওয়ায় বৈঠকের শুরুতে ধন্যবাদ জানান জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য সদস্য আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, সফর রাজ হোসেন, বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান প্রমুখ। সংলাপ সঞ্চালনা করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এ আলোচনায় তাড়াহুড়োর চেয়ে ঐকমত্যকে বেশি প্রাধান্য দেওয়ার কথা জানান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ‘কিছু আলোচনা সমাপ্ত হয়নি, সেটা আগামী সপ্তাহের আলোচনায় পুনরায় তোলা হবে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে, আলোচনার কোনো অংশকে পুনরুক্তি না করে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করার জন্য।’ গতকালের সংলাপে বড় অগ্রগতি অর্জনের আশা প্রকাশ করে অধ্যাপক আলী রীয়াজ আরও বলেন, ‘আগামী জুলাইয়ের মধ্যেই আমাদের জাতীয় সনদ তৈরির কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। কাজেই আমাদের সময়ের স্বল্পতাও রয়েছে। বিষয়টিও রাজনৈতিক দলগুলোর খেয়াল রাখতে হবে।’