অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের টানা কয়েক দিনের সংলাপে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়ে নানা ইস্যুতে আলাপ-আলোচনা করেন। গতকালের বৈঠকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিবর্তন ও দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠনে ঐকমত্যে পৌঁছে রাজনৈতিক দলগুলো। তবে, দুই মেয়াদের বেশি একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, এ নিয়ে অনৈক্য রয়ে গেছে।
জানা গেছে, একইসঙ্গে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। তবে উচ্চকক্ষে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে এখনও একমত হতে পারেনি সবাই। এ নিয়ে আগামী রোববার আবারও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অধিবেশনে আলোচনা হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ শেষে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কীভাবে হবে তা চূড়ান্ত না হলেও বর্তমান বিধান পরিবর্তনে সবাই একমত হয়েছে। বৈঠকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, সংবিধান, রাষ্ট্রের মূলনীতি ও নির্বাচনি এলাকা নির্ধারণ নিয়ে সংলাপ হয়। সংলাপে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ ৩০টি দলের প্রতিনিধি অংশ নেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল, জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল, এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল বৈঠক উপস্থিত ছিলেন। এতে সংলাপ সঞ্চালনা করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। সংলাপে আরও উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া।
অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনায় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল স্মরণ করিয়ে দেয় এর সঙ্গে পার্লামেন্টের দ্বিকক্ষ জড়িত। রাষ্ট্রপতি কীভাবে নির্বাচিত হবেন, সেক্ষেত্রে উচ্চকক্ষ কীভাবে হবে, তার পেছনে আমরা দ্বিকক্ষ পার্লামেন্ট নিয়ে আলোচনা করেছি। সংবিধানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের যে বিধান আছে, ৪৮ এর ১ অনুচ্ছেদ আছে, এই অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। পরিবর্তিত, সংশোধিত ও সংস্কারের বিষয়টি আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করব। তিনি আরও বলেন, আমাদের আলোচনায় বিভিন্ন রকম মত থাকলেও আলোচনাটি অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে হচ্ছে। প্রত্যেকেই মতামত দিচ্ছে। বৈঠকে আমরা সবাই একমত হয়েছি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের যে পদ্ধতি রয়েছে তা পরিবর্তন হওয়া দরকার।
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল নিয়ে আলী রিয়াজ বলেন, দুই মেয়াদের বেশি একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কয়েকটি দল একই ব্যক্তি দুইবার প্রধানমন্ত্রী থাকার বিষয়টি বিবেচনা করার কথা বলেছে। অন্যান্য আরও কিছু প্রস্তাবও এসেছে। আমরা এই আলোচনা অব্যাহত রাখব এবং আগামী রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় আবার আলোচনা শুরু করব। আমরা আশা করব, এ সপ্তাহে যেসব বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেছে, সেগুলো প্রথমে আলোচনা করব।
দ্বিকক্ষ আইনসভা নিয়ে সবাই একমত হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। ১০০ সদস্য বিশিষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রেও একমত হয়েছে। তার মানে এই নয় যে, এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে আরও সংশ্লিষ্ট বিষয় রয়েছে, যেগুলো ঐকমত্য হলে পরে জানানো হবে। কিন্তু যেগুলো একমত হবে না তার ভবিষ্যৎ কী হবে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা আশাবাদী অনেকগুলো বিষয়ে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারব। সব বিষয়ে আমরা একমত হতে পারব না, সেটা আগেও বলেছি। তারপরও যেগুলো উল্লেখযোগ্য বিষয়ে একমত হতে পারব না, সেগুলো আমরা ইতিবাচকভাবে তুলে ধরব। আমরা আশা করব, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে আমরা একমত হতে পারব।
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নায়েবে আমির আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হলে এবং নারী আসন ১০০ হলে উচ্চকক্ষ এবং নিম্নকক্ষ মিলিয়ে ৫০০ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’ অনেকে আবার জেলা পরিষদ এবং সিটি কর্পোরেশন মিলিয়ে আরও অতিরিক্ত ৭৬ ভোট অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান তিনি। জামায়াতের এই নায়েবে আমির বলেন, প্রক্রিয়া যাই হোক, আমরা এক্সটেন্ডেড ইলেকট্রোরাল কলেজ পদ্ধতিকে সমর্থন করি। পাশাপাশি গোপন ব্যালটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য সুপারিশ করেছি। জামায়াতের সব অভ্যন্তরীণ নির্বাচন গোপন ব্যালটে হয়; দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনও সেভাবেই হওয়া উচিত।’ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রসঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর বলেন, ‘এখন পর্যন্ত নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা চলছে। অনেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইউনিয়ন পরিষদকেও অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছে। এতে করে ৫৭৬ ভোটের বাইরে আরও ৭০ হাজার অতিরিক্ত ভোট যুক্ত হবে।’ কমিশনের নিরপেক্ষতার প্রসঙ্গ তুলে নূর বলেন, ‘এখনও দুই একটি দলের প্রতি কমিশনের দুর্বলতা দেখা যায়। এটা পরিবর্তন করতে হবে। এছাড়া আলোচনায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা ১৪ দলের কয়েকটি শরীক দলকে আমন্ত্রণ করেছে কমিশন। ফ্যাসিস্টদের সঙ্গ দেওয়া কোনো দলকে আমরা সমর্থন জানাব না।’
মহাজোটের দুই শরিককে আমন্ত্রণে নূর ও ইরানের ক্ষোভ : জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে ১৪ দলীয় মহাজোটের দুই শরিক দলকে আমন্ত্রণ জানানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর ও বাংলাদেশের লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইবেন নূর, আর আগামীতে এমনটি হলে ওয়াকআউট করার হুমকি দেন ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান।
ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের চতুর্থ দিনের সংলাপের বিরতিতে সাংবাদিকদের সামনে এসে ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের দুই শরিক বাংলাদেশ জাসদ ও জাকের পার্টিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তিনি বলেন, এটি জুলাই আকাঙ্ক্ষার প্রতি কুঠারাঘাত। আগামীতে এসব দলকে আমন্ত্রণ জানালে আমরা সংলাপ বয়কট করব। এরপর নুরুল হক নূর বলেন, সংলাপে ফ্যাসিবাদের দোসর দুটি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটি জুলাইয়ের চেতনার প্রতি সুস্পষ্ট অবমাননা। আমরা এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইবো। নূর আরও বলেন, সংলাপে দুই-একটি দলকে প্রাধান্য দিচ্ছে ঐকমত্য কমিশন, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ বিষয়ে তিনি সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।