ঢাকা শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

তিন পথে হাঁটছে বিএনপি

তিন পথে হাঁটছে বিএনপি

আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা না হলেও তিন পথে হাঁটতে শুরু করেছে বিএনপি। প্রথমত, সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি; দ্বিতীয়ত, সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার এবং তৃতীয়ত, কূটনৈতিক তৎপরতা। দলটি এখন তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছে। এরইমধ্যে দলটির হাইকমান্ড থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নির্বাচনি প্রস্তুতি নিতেও বলা হয়েছে। তারাও নিজ নিজ এলাকায় নানাভাবে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে নবায়ন এবং দলের প্রাথমিক সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু করেছে বিএনপি। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির কূটনৈতিক তৎপরতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, চীন, রাশিয়া ও জাপানের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক এবং লন্ডনে তারেক রহমানের মাধ্যমে উচ্চপর্যায়ের আলোচনার মধ্য দিয়ে দলটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের অবস্থান জোরালো করার চেষ্টা করছে।

এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু না করলেও ভেতরে ভেতরে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ করছে বিএনপি। সূত্রমতে, নির্বাচনকে ঘিরে নেওয়া হচ্ছে প্রার্থীদের বিভিন্ন তথ্য। প্রত্যেক আসনে বিএনপির প্রায় ২ থেকে ৫ জন করে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে। জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাই করা হচ্ছে। এর বাইরে প্রার্থীর দৃষ্টিভঙ্গি, চরিত্র, শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে মনোনয়ন দেওয়া হবে। দলীয় সূত্র জানায়, এবার দলীয় মনোনয়নে বড় পরিবর্তন আসতে পারে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের চেতনাকে প্রাধান্য দিয়ে তরুণ প্রার্থীদের সুযোগ দেওয়া হবে বেশি। এ ছাড়া সরকার পরিচালনায় যারা দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারবেন নতুন প্রজন্মের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করতে পারবেন- এমন প্রার্থীদেরও গুরুত্ব দেওয়া হবে।

বিএনপির নেতারা বলছেন, বিএনপি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল। এই দলের নির্বাচনি প্রস্তুতি সব সময়ই থাকে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও প্রার্থী বাছাই শুরু হয়নি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে, এরপরে আমরা মনোনয়নপত্র নেওয়ার জন্য আহ্বান জানাব। আর রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক কাজই হচ্ছে নির্বাচনি প্রস্তুতি। সেই প্রস্তুত আমাদের চলছে।

সূত্রমতে, বিএনপির পুনর্গঠন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গঠন করা হচ্ছে নতুন কমিটি। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে নতুন কমিটি। এই পুনর্গঠনের মাধ্যমে গত ১০ মাসে যারা দলের কর্মসূচিতে একাত্মতা না থেকে জোর-জবরদস্তি করে দখল, চাঁদাবাজি এবং অবৈধভাবে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন তাদের দল থেকে ঝেড়ে ফেলা হচ্ছে। এরইমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও দলীয় সূত্র জানিয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেছেন, আমরা এখন সাংগঠনিক কাজ করছি। সকল সাংগঠনিক কাজই এখন নির্বাচনকেন্দ্রিক হবে। নতুন কমিটি হচ্ছে, মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি করা হচ্ছে। এসবই এখন হবে নির্বাচনকেন্দ্রিক। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য বলেন, এখন বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে। তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে। যখন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে, তখন নির্বাচনকেন্দ্রিক মূল কাজ আমরা করব।

জানা যায়, আসন্ন সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুনভাবে সদস্য সংগ্রহ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের কাছে যেতে চায় দলের হাইকমান্ড। এরইমধ্যে ছয়টি সাংগঠনিক বিভাগে সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। দীর্ঘ ৮ বছর পর এবার বিএনপির টার্গেট নতুনভাবে কোটি সদস্য সংগ্রহ করা। এরপর নতুন-পুরোনোদের নিয়ে ডিজিটাল তালিকা বা তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

জানা গেছে, নির্বাচনি দাবি-দাওয়া, দল পুনর্গঠন ও রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেই নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযানে যাচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ড। মূলত তিনটি কারণে সারা দেশে দলীয়ভাবে নেতাকর্মীদের প্রাথমিক সদস্যপদ নবায়ন ও নতুন সদস্য সংগ্রহ করা হবে। এই তিন কারণ হলো- ১. আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জনশক্তিকে সক্রিয় করা, ২. দলের জন্য বৈধ তহবিল সংগ্রহ ও বৃদ্ধি করা এবং ৩. দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ফেরানো। চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের পর গত ২০ জানুয়ারি রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সদস্য পদ নবায়নের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গত ২০ জানুয়ারি সদস্য পদ নবায়ন কর্মসূচির উদ্বোধনকালে নিজের সদস্য পদ নবায়ন করেন তারেক রহমান। সে সময় তিনি বলেন, আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে চাই জনগণের সমর্থন পাব। দল পুনর্গঠনের পর আমরা রাষ্ট্রকেও পুনর্গঠন করব। ৩১ দফা কার্যকর করা হবে।

জানা গেছে, বর্তমানে বিএনপির প্রাথমিক সদস্য আছেন প্রায় ৭০ লাখ। তবে এ নিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। এবার নতুনভাবে শুরু হওয়া সদস্য নবায়ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রাথমিক সদস্যসহ দলীয় নেতাকর্মীদের একটি ডাটাবেজ তৈরি করতে চায় বিএনপি। এ বিষয়ে কাজও শুরু হয়েছে।

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি জ্যাকবসনের সঙ্গে নির্বাচন ও অর্থনৈতিক বিষয়ে আলোচনা, চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সফর ও সহযোগিতা নির্ধারণ, জার্মান রাষ্ট্রদূতের সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং রাশিয়া-জাপানের সঙ্গে রাজনৈতিক ও বিনিয়োগ সংলাপ-সবই বিএনপির পররাষ্ট্র কৌশলের সুচিন্তিত রূপরেখার ইঙ্গিত দেয়।

এক যুগের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা একটি রাজনৈতিক দলের জন্য আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বজায় রাখা যেমন চ্যালেঞ্জ, তেমনি কৌশলগত বুদ্ধিমত্তারও প্রমাণ। তবে শুধু বৈঠকেই নয়, এই সম্পর্কগুলো কতটা বাস্তব রাজনৈতিক প্রভাব তৈরি করতে পারে- তা নির্ভর করবে বিএনপির ঘরোয়া রাজনৈতিক অবস্থান ও জনসম্পৃক্ততার উপর।

বলা যায়, অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের পাশাপাশি কূটনৈতিক ফ্রন্টেও বিএনপি এখন অনেক বেশি সচল। এর সফলতা নির্ভর করবে ভবিষ্যতে কতটা কার্যকর নীতিনির্ধারণ ও জনমত প্রভাবিত করার ক্ষমতার উপর।

বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত জার্মানির বিদায়ী রাষ্ট্রদূত আখিম ট্রোসটার। এ সময় সঙ্গে ছিলেন তার সহধর্মিণীও। গত শুক্রবার (২০ জুন) রাত সাড়ে ৮টায় গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের বাসভবন ফিরোজায় এই সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় খালেদা জিয়া ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার।

এদিকে, ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গুরুত্বপূর্ণ এই বৈঠকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানায় বিএনপি সূত্র।

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে ঐতিহাসিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে তারেক রহমান আগামী রমজানের আগে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব করেন। প্রধান উপদেষ্টা জানান, ‘সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে রমজানের আগের সপ্তাহেও নির্বাচন হতে পারে।’ লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের সময় নিয়ে সমঝোতার আভাস পাওয়ার পর দেশে নির্বাচনি আবহ তৈরি হয়েছে। নির্বাচনের সময় নিয়ে যে অনিশ্চয়তা ছিল তা কেটে গেছে এই বৈঠকের মাধ্যমে। বৈঠকের বার্তা পাওয়ার পর নির্বাচনি তৎপরতা শুরু করছে দলগুলো। যদিও কিছু দল আগে থেকে নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু করেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত