ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সমাধান নয়, সংঘাতের পদধ্বনি

সমাধান নয়, সংঘাতের পদধ্বনি

কবে হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন- তা এখনও স্পষ্ট নয়। এরইমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা নির্বাচনকেন্দ্রিক পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেওয়া শুরু করেছেন। বিএনপি ও তার মিত্ররা বলছে, নির্বাচন ফেব্রুয়ারির মধ্যেই হতে হবে। জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিসহ কিছু দল বলছে, সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হতে হবে এবং সংসদ নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে হবে। নিজেদের দাবিতে অনড় থেকে দুই পক্ষই পাল্টাপাল্টি হুঁশিয়ারিও দিচ্ছেন। ফলে নির্বাচনের সময় নিয়ে যে সমাধানের পথ তৈরি হয়েছিল, তাতে এখন সংঘাতের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সূত্রমতে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একসময় বলেছিলেন, আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। পরে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করেন, এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে। সবশেষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনে বৈঠক করে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, সংস্কার ও বিচার কাজের অগ্রগতি হলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। অর্থাৎ, আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথামার্ধে নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নিয়ে ঐকমত্য নেই। একাংশের মধ্যে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিও যেমন রয়েছে, তেমনি অন্য অংশের নেতারা এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও সময় নিতে বলছেন।

এমন প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সিইসির বৈঠকটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এ বৈঠককে অনেকে লন্ডন বৈঠকের ফলোআপ হিসেবে দেখছেন। তারা মনে করছেন, এ বৈঠকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ এবং সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকতে পারে। অন্যদিকে, কিছু সূত্র আভাস দিচ্ছে, কয়েকটি দলের ইসি পুনর্গঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা সিইসির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়েই মূলত আলোচনা হয়েছে।

এদিকে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বৈঠকের বিষয়গুলো জনগণের সামনে স্পষ্ট করার দাবি জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বিএনপির ধারণা, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন বিষয়ে আলোচনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ও সিইসি। বিএনপি মনে করছে, নির্বাচন সংক্রান্ত প্রস্তুতি সেপ্টেম্বরের মধ্যেই নেওয়া সম্ভব।’ তিনি বলেন, বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা হয়তো তার ম্যাসেজ সিইসিকে জানিয়েছেন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ধরে প্রস্তুতি নিতে। এটি আমাদের ধারণা। উভয় পক্ষ থেকে বার্তা এলে সেটি স্পষ্ট হবে।’ পক্ষান্তরে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সিইসির বৈঠকে কোনো বার্তা না থাকায় নির্বাচন কবে হচ্ছে তা নিয়ে নানা প্রশ্নও দেখা দিচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সংস্কারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, সংবিধান, নির্বাচন পদ্ধতি, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ও ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, উচ্চকক্ষ গঠন, নারী আসন, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন ইত্যাদি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। বেশ কিছু বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও আবার বেশ কিছু বিষয়ে এখন পর্যন্ত সমঝোতা থেকে অনেক দূরেই অবস্থান করছে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি ছাড়া আগামী নির্বাচন দেশের মানুষ মানবে না। এ নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঐক্য তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘দৃশ্যমান সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে। যারা বলেন ক্ষমতায় গেলে সংস্কার করবেন, তারা কীভাবে বুঝলেন তারা ক্ষমতায় যাবেন?’ মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু কিছু আচরণ জনগণের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করেছে। নির্বাচনের আগে নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে হবে। লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।’ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাইর পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচনে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে। যে যত শতাংশ ভোট পাবে তাদের তত শতাংশ প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এটা এখন জনগণের দাবি, অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের দাবি।’ এসময় তিনি বিএনপিকেও পিআর সিস্টেমে নির্বাচনে আসা উচিত বলে মত দেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সমাবেশে যোগ দিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন যেন পিআর পদ্ধতিতে হয়, সেই দাবি নিয়ে জোরেজোরে জাগতে হবে। তিনি বলেন, দেশ ও জনগণের জন্য প্রয়োজনে তারা আবারও লড়াইয়ে নামবেন। ‘পিআর পদ্ধতি কই থেকে আসে’ এমন প্রশ্ন করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, দেশটাকে সুন্দর করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে কিছু করেন না, শুধু আপনার কথামতোই হতে হবে, স্থানীয় সরকার আগে হতে হবে, আবার পিআর ভোট করতে হবে। কেন ভাই? কই থেকে আবিষ্কার করেন এগুলা? কে দেয় বুদ্ধি আপনাদের? এসব কুপরামর্শ নিয়ে, এই দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করার জন্য একদল লোক আজ মাঠে নেমেছে।

আগামী ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে- এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হবে না এরকম কোনো লক্ষণ আমি দেখছি না। শুধু শুধু এটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার দরকার তো নেই। আমি দেখছি নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সারা দেশ নির্বাচনে নেমে পড়েছে, সারা দেশের মানুষ প্রস্তুতি নিচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য। নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি নিচ্ছে, তারা তৈরি আছে। যে বিষয়টা হয়নি, এটাকে শুধু শুধু প্রশ্নবিদ্ধ করে, আননেসেসারি আগামী নির্বাচনকে ব্যাহত করার চেষ্টা করে তো কোনো লাভ নেই। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, নির্বাচনের দিনটার জন্য মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে গণতন্ত্র রক্ষা পাবে। তাই যত বাধা-বিপত্তি আসুক না কেন, ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হতেই হবে। এর সঙ্গে কোনো আপস নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একদিকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানে দৃঢ় অবস্থানে বিএনপি ও তার মিত্ররা, অন্যদিকে পিআর বা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে নতুন করে সরব জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপির মতো দলগুলো। পরস্পর বিপরীতমুখী এই অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন বাড়তে থাকায় জাতীয় নির্বাচন আয়োজন নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে সমাধান নয়, বরং সংঘাতের পদধ্বনি দেখতে পাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত