জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের টানা আন্দোলনের কারণে রাজস্ব আয়ের বিরাট ঘাটতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সেই আশঙ্কা দূরীকরণে এনবিআরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সরকার। এরইমধ্যে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনারসহ পাঁচজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বন্দর কার্যক্রমে ‘কমপ্লিট শাতডাউন’ দেওয়ার পর আরও কঠোর অবস্থানে গেছে সরকার।
জানা গেছে, এনবিআরে জনবল রয়েছে প্রায় ২৩ হাজার। তাদের মধ্যে প্রায় ১৫০০ ক্যাডার কর্মকর্তা। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরাজ করছে ভয়, ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তা।
বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের কঠোর অবস্থানে আপাতত শৃঙ্খলা ফিরে এলেও এ পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদে এনবিআরের কাঠামোগত সংস্কার প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, আত্মবিশ্বাসহীন একটি প্রশাসনিক কাঠামো থেকে কার্যকর সংস্কার সম্ভব নয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এনবিআরের যেসব কর্মকর্তা বিশৃঙ্খল করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন তাদের অন্তত আরও ছয়জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মধ্যে সাময়িক বরখাস্ত থেকে শুরু করে বদলি পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত দুই দিনে ১১ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে। যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে এনবিআরের শীর্ষস্থানীয় দুইজন কর্মকর্তা বাদে বাকিরা আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন। ফলে কর্মকর্তাদের অভিযোগ, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মতো বর্তমান সরকারও দুদককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। যদিও অর্থ উপদেষ্টা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এনবিআরের চারজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) থেকে এ-সংক্রান্ত পৃথক দুটি আদেশ জারি করা হয়। আন্দোলনরত এনবিআর কর্মকর্তাদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে শুল্ক কার্যক্রম ব্যাহত করার অভিযোগে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনারকে সাময়িক বরখাস্ত করার ঠিক একদিন পরই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। অবসরে পাঠানো কর্মকর্তারা হলেন: এনবিআরের সদস্য (চলতি দায়িত্ব) (মূসক নীতি) ড. মো. আবদুর রউফ, সদস্য (গ্রেড-২) (সদস্য শুল্ক নীতি ও আইসিটি) হোসেন আহমদ, সদস্য (কর) (গ্রেড-২) আলমগীর হোসেন ও বরিশাল কর অঞ্চলের কমিশনার (চলতি দায়িত্ব) শাব্বির আহমেদ। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, চার কর্মকর্তারই চাকরিকাল ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। সরকার জনস্বার্থে তাদের চাকরি থেকে অবসর দেওয়ার কথা বিবেচনা করেছে। সেজন্য সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ এর ৪৫ ধারার ক্ষমতাবলে তাদের সরকারি চাকরি থেকে অবসর প্রদান করা হয়েছে। তারা বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী অবসরকালীন সুবিধাদি পাবেন। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, পরিস্থিতি যাতে আর উত্তপ্ত না হয়, সেজন্য শান্ত থাকতে এনবিআর চেয়ারম্যান এবং অর্থ উপদেষ্টাকে আমরা চিঠি পাঠাব, এর ড্রাফট রেডি হচ্ছে। অসৎ অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, তবে তার আগে সংস্কার করতে হবে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ‘বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ ছিল এটা সত্য, তবে সমঝোতার আশ্বাসে আমরা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজে ফেরত এনেছিলাম। এখন যদি তাদের শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আর কেউ মধ্যস্থতায় আসবে না।’
প্রসঙ্গত, একটি অধ্যাদেশ জারি করে গত ১২ মে এনবিআর বিলুপ্ত করে ‘রাজস্ব নীতি’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’ নামে দুটি বিভাগ গঠনের ঘোষণা দেয় সরকার। কর্মকর্তাদের অভিযোগ, প্রশাসন ক্যাডারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’-এর ব্যানারে আন্দোলন শুরু হয়। ২৮-২৯ জুন ঢাকায় ‘মার্চ টু এনবিআর’ এবং ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির মাধ্যমে বিভিন্ন বন্দরের কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর মধ্যস্থতায় আন্দোলন প্রত্যাহার করলেও সরকার এখন একের পর এক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে, এ অভিযোগ আন্দোলনে অংশ নেওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ব্যবসায়ী নেতাদের আশ্বস্ত করেছেন, বড় ধরনের আর ‘ক্র্যাকডাউন’ হবে না। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলেছে, শিগগিরই আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।