ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই ২০২৫, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মদিনা শরিফের জুমার খুতবা

প্রতিবেশীর মর্যাদা ও অধিকার

শায়খ ড. আবদুল্লাহ বিন আবদুর রহমান আল-বুআইজান
প্রতিবেশীর মর্যাদা ও অধিকার

দুনিয়ার কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে মানুষ অনেক সময় দ্বীন সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভুলে যায়, আর তা হলো প্রতিবেশীর অধিকার। শরিয়তের আদব, মানবীয় নীতি ও মূল্যবোধগুলোর অন্যতম হলো প্রতিবেশীর অধিকার সংরক্ষণ করা, তার প্রতি যত্নশীল হওয়া ও তাদের অধিকার আদায় করা। এটি উত্তম চরিত্রের মূল অংশ, যা নৈতিকতার মানদ- ও ন্যায়ের প্রতীক। মহান আল্লাহ প্রতিবেশীর প্রতি সদাচার করতে উৎসাহিত করে তাদের বিষয়ে সুপারিশ করে বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোন কিছুকে তার সঙ্গে শরিক করবে না; পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, নিকট-প্রতিবেশী, দূর-প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক, অহংকারীকে।’ (সুরা নিসা : ৩৬)।

প্রতিবেশীর গুরুত্ব : প্রতিবেশীর প্রতি সম্মানপ্রদর্শন ও তাদের প্রতি সদাচার করা একটি বড় দায়িত্ব। এটি নৈতিকতার উৎকৃষ্ট নিদর্শন ও সুদৃঢ় মুসলিম সমাজ গঠনের ভিত্তি। হজরত জিবরাইল (আ.) বিশ্বনবী (সা.) কে প্রতিবেশীর অধিকারের ব্যাপারে এত গুরুত্ব সহকারে সুপারিশ করেছেন যে, তিনি মনে করেছিলেন, প্রতিবেশীদের বুঝি সম্পদের উত্তরাধিকারী করা হবে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হজরত জিবরাঈল (আ.) সর্বদা আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে সুপারিশ করতে থাকেন। এমনকি আমার ধারণা হয় যে, শিগগিরই প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারী করে দেয়া হবে।’ (বোখারি : ৬০১৫)।

আল্লাহতায়ালা ও পরকালের প্রতি ঈমানের শর্তগুলোর একটি হলো প্রতিবেশীকে সম্মান করা, তাদের সঙ্গে সদাচার করা, তাদের কোনো ক্ষতি না করা ও তাদের পক্ষ হতে যে কোনো কষ্ট সহ্য করা। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে। যে আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে জ্বালাতন না করে। যে লোক আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ (বোখারি : ৬০১৮)।

প্রতিবেশীর নিরাপত্তা : ঈমানের শর্তগুলোর অন্যতম হলো প্রতিবেশীর নিরাপত্তা বিধান করা। যতক্ষণ প্রতিবেশী কোনো ব্যক্তির ক্ষতি, প্রতারণা, অন্যায় ও অত্যাচার থেকে নিরাপদ না হবে, ততক্ষণ তার ঈমান পূর্ণ হবে না। হজরত আবু শুরাইহ (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর শপথ! সে ব্যক্তি মোমিন নয়। আল্লাহর শপথ! সে ব্যক্তি মোমিন নয়। আল্লাহর শপথ! সে ব্যক্তি মোমিন নয়। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! কে সে লোক? তিনি বললেন, যে লোকের প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ নয়।’ (বোখারি : ৬০১৬)। ঈমানের শর্তগুলোর একটি হলো, মানুষ যেন নিজের জন্য যা ভালোবাসে, তার প্রতিবেশীর জন্যও তা ভালোবাসে। হজরত আনাস (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মোমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা যা পছন্দ করো তা অন্য ভাইয়ের জন্যও পছন্দ করবে। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, প্রতিবেশীর জন্যও পছন্দ করবে। (মুসলিম : ৭৪)।

জাহান্নামের ধমক : প্রতিবেশীর প্রতি সদাচার জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম কারণ, আর তাদের কষ্ট দেয়া জাহান্নামে যাওয়ার কারণ। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি বিশ্বনবী (সা.)-এর কাছে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল, অমুক নারীর ব্যাপারে বলা হয়, সে প্রচুর নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, দান-সদকা করে, কিন্তু সে তার প্রতিবেশীকে জিহ্বার মাধ্যমে কষ্ট দেয়!’ মহানবী (সা.) বললেন, ‘সে জাহান্নামে যাবে।’ আরেক ব্যক্তি বলল, ‘অমুক নারী সম্পর্কে বলা হয়, সে খুব অল্প রোজা রাখে, অল্প দান করে ও অল্প নামাজ পড়ে। কিন্তু সে প্রতিবেশীকে জিহ্বার মাধ্যমে কষ্ট দেয় না!’ নবী করিম (সা.) বললেন, ‘সে জান্নাতে যাবে।’ (ইবনে হিব্বান : ৫৭৬৪)।

ভালো ও মন্দ প্রতিবেশী : প্রতিবেশীর সাক্ষ্য একজন ব্যক্তির অবস্থা নির্ধারণে গ্রহণযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ মানদ-। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমাকে এমন একটি কাজের দিকনির্দেশনা দিন, যা করলে আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব। বিশ্বনবী (সা.) বললেন, ‘তুমি ভালো আচরণ করো।’ সে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কীভাবে জানব যে, আমি ভালো আচরণকারী?’ নবী করিম (সা.) বললেন, ‘তোমার প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করো। যদি তারা বলে তুমি ভালো আচরণকারী, তাহলে তুমি তা-ই। আর যদি তারা বলে তুমি খারাপ আচরণকারী, তাহলে তুমি খারাপ।’ (মুস্তাদরাকে হাকিম)। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে মুসলমান মারা যায়, আর তার সম্পর্কে চারজন প্রতিবেশী সাক্ষ্য দেয়, তারা তাকে ভালো ছাড়া কিছু জানে না, আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করলাম ও তোমরা যা জানো না, তা ক্ষমা করে দিলাম।’ (ইবনে হিব্বান)।

প্রতিবেশীর অধিকার : হে মানবসকল! আল্লাহর ভয়ে তোমাদের প্রতিবেশীদের প্রতি দায়িত্ব পালন করো। আল্লাহ তোমাদের ওপর যে দায়িত্ব ও অধিকার নির্ধারণ করেছেন, তা পালন করো। প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণ করো, তার সম্মান রক্ষা করো, এমনকি সে অন্যায় করলেও। প্রতিবেশীর অধিকারের মধ্যে রয়েছে তার প্রতি ধৈর্য ধারণ করা, তার দেয়া কষ্ট সহ্য করা, তার ব্যক্তিগত বিষয় থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখা, তার ভুলত্রুটি ক্ষমা করা ও তার দোষ খুঁজে বেড়ানো থেকে বিরত থাকা।

প্রতিবেশীর অন্যতম অধিকার হলো তাকে কোনো প্রকার কষ্ট না দেয়া। যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীর ওপর অত্যাচার করে, তার বাড়ি থেকে বরকত উঠে যায়। প্রতিবেশীর গুণের উপরই তার বাড়ির মর্যাদা নির্ভর করে। আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই খারাপ প্রতিবেশী থেকে, যার চোখ বিশ্বাসঘাতকতা করে ও যার কান চুপিসারে শোনে। সে ভালো কিছু দেখলে তা গোপন করে, আর খারাপ কিছু শুনলে তা প্রচার করে। এমন প্রতিবেশী থেকে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন।

দেখা হলে সালাম দেয়া, অসুস্থ হলে খোঁজ নেয়া, বিপদে সমবেদনা জানানো, দুঃখে সান্ত¡না দেয়া, গোপন কথা প্রকাশ না করা ও সম্মান রক্ষা করা প্রতিবেশীর উল্লেখযোগ্য অধিকার। হজরত আবু জর (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (রা.) বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ তিন ধরনের মানুষকে ভালোবাসেন। তাদের মধ্যে একজন হলো, যার খারাপ প্রতিবেশী তাকে কষ্ট দেয় ও সে ধৈর্য ধরে, যতক্ষণ না আল্লাহ তার জন্য মুক্তির ব্যবস্থা করেন।’ (মুস্তাদরাকে হাকিম)

প্রতিবেশীর প্রতি সদাচার করা, তার খোঁজখবর নেয়া ও তাকে সাহায্য করা ইসলামের শিক্ষা। হজরত আবু জর (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হে আবু জর, যখন তুমি তরকারি রান্না করবে তখন তাতে পানি (ঝোল) বেশি দিও এবং তোমার প্রতিবেশীকে কিছু প্রদান করো।’ (মুসলিম : ৬৫৮২)।

মুসলিম নারীগণ! তোমরা তোমাদের প্রতিবেশীর প্রতি সদাচরণ করো। কেউ কোনো উপহার দিলে তুচ্ছ মনে করো না, যদিও তা একটি ভেড়ার খুর হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হে মুসলিম নারীগণ! কোন মহিলা প্রতিবেশিনী যেন অপর মহিলা প্রতিবেশিনীর হাদিয়া তুচ্ছ মনে না করে, এমনকি তা ছাগলের সামান্য গোশতযুক্ত হাড় হলেও।’ (বোখারি : ২৫৬৬)।

প্রতিবেশীর অধিকার তার নৈকট্যের ওপর ভিত্তি করে বাড়ে। সবচেয়ে নিকটবর্তী প্রতিবেশী সবচেয়ে বেশি অধিকার রাখে। মসজিদের জামাতের সবাই ও এলাকার সবাই প্রতিবেশী হিসেবে বিবেচিত হয়। তাদের অধিকার তাদের দূরত্ব অনুযায়ী নির্ধারিত হয়।

হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমার দুইজন প্রতিবেশী রয়েছে। আমি তাদের মধ্যে কার জন্য উপহার নিয়ে যাব?’ তিনি বললেন, ‘যে তোমার সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে।’ (বোখারি : ২২৫৯)। (২৪-০৭-১৪৪৬ হিজরি; মোতাবেক ২৪-০১-২০২৫ ঈসায়ি তারিখে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- আবদুল কাইয়ুম শেখ)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত