বান্দার প্রতি আল্লাহতায়ালার বড় অনুগ্রহ হলো, বান্দা আল্লাহর প্রতি তার আনুগত্যের কাজগুলো আঞ্জাম দেওয়ার সুযোগ পাওয়া। আল্লাহর ইবাদত ঠিকভাবে পালন করতে ও মানুষের হক নষ্ট না করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত থাকা। এটা বান্দার প্রতি আল্লাহতায়ালার এমন এক অনুগ্রহ যা বান্দাকে সব ধরনের জুলুম থেকে বাঁচিয়ে রাখে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি কখনও মনে কর না, জালিমরা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ গাফিল, তবে তিনি এদের সেই দিন পর্যন্ত অবকাশ দেন, যেদিন তাদের চোখ হবে স্থির।’ (সুরা ইবরাহিম : ৪২)। এছাড়া, এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর বাণী বর্ণনা করে বলেন, ‘হে আমার বান্দারা! আমি নিজের উপর জুলুমকে হারাম করেছি ও তোমাদের মধ্যেও একে হারাম করেছি। অতএব, তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম কর না।’ ( মুসলিম : ৬৪৬৬)
মানব ধ্বংসের কারণ : মানুষের ওপর জুলুম করার জন্য নিজের প্রবৃত্তিকে ছাড় দিয়ে রাখাটা সবচেয়ে বড় ধ্বংসাত্মক ও চরম ক্ষতির কারণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা জুলুম থেকে বেঁচে থাক, কারণ জুলুম কেয়ামতের দিন অন্ধকারের রূপ পরিগ্রহ করবে।’ (মুসলিম : ৬৪৭০)
তাই, হে মুসলিম! মনে রেখো, তোমার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো নিজের নেক আমলগুলো সংরক্ষণ করা ও নিজের দ্বীনকে নিরাপদ রাখা। কারণ কেয়ামতের দিন মানুষ তার ভাই, মা, বাবা, স্ত্রী ও সন্তান থেকে পালিয়ে বেড়াবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর কেয়ামত দিবসে আমি স্থাপন করব ন্যায়বিচারের মানদ-। সুতরাং কারো প্রতি কোনো অবিচার করা হবে না। আর কর্ম যদি তিল পরিমাণ ওজনেরও হয় তবু তা আমি উপস্থিত করব। হিসেব গ্রহণকারীরূপে আমিই যথেষ্ট।’ (সুরা আম্বিয়া : ৪৭)।
সত্যিকারের দেউলিয়াত্ব ও বড় ধরনের ক্ষতি হলো, তুমি ইবাদত ও ভালো কাজের ক্ষেত্রে দুনিয়ার জীবনে খুব অগ্রসর; কিন্তু কেয়ামতের দিন মানুষের হক নষ্ট করার কারণে তাদের দাবির মুখে পড়ে ভীষণ বিপদে পড়বে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাই-এর ওপর জুলুম করেছে সে যেন তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয়, তার ভাই-এর পক্ষে তার থেকে পুণ্য কেটে নেওয়ার আগেই। কারণ সেখানে কোনো দিনার বা দিরহাম পাওয়া যাবে না। তার কাছে যদি পুণ্য না থাকে তবে তার মাজলুম ভাই-এর গোনাহ এনে তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।’ (বোখারি : ৬৫৩৪)।
আখেরাতে দেউলিয়া : পুরোপুরি দেউলিয়াত্ব হলো, যাদের অধিকার নষ্ট করেছিলে তারা তোমার নেক আমলগুলো নিয়ে নেবে অথবা তাদের পাপগুলো তোমার কাঁধে চাপিয়ে দেবে। ?হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কি বলতে পার অভাবী লোক কে? তারা বললেন, আমাদের মাঝে যার টাকা কড়ি ও ধন-সম্পদ নেই সে-ই অভাবী লোক। তখন বিশ্বনবী (সা.) বললেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে সে প্রকৃত অভাবী লোক, যে ব্যক্তি কেয়ামতের দিন নামাজ, রোজা ও জাকাত নিয়ে আসবে; অথচ এ অবস্থায় আসবে যে, সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, অমুকের সম্পদ জবরদখল করে ভোগ করেছে, অমুককে হত্যা করেছে ও আরেকজনকে প্রহার করেছে। এরপর সে ব্যক্তিকে তার নেক আমল থেকে দেয়া হবে, অমুককে নেক আমল থেকে দেয়া হবে। এরপর যদি পাওনাদারের হক তার নেক আমল থেকে পূরণ করা না যায় সে ঋণের পরিবর্তে তাদের পাপের একাংশ তার প্রতি নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (মুসলিম : ৬৪৭৩)। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার। তাই নিরাপত্তা প্রত্যাশী হে মানুষ! মানুষের ওপর জুলুম করা থেকে নিজেকে বাঁচাও, দ্রুত তাদের হক আদায় কর ও তাদের ক্ষমা চেয়ে নাও। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘শুধু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে ও পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহাচরণ করে বেড়ায়। এদের জন্যে মর্মন্তুদ শাস্তি।’ (সুরা শূরা : ৪২)।
ওহে যে মুখ ও কলম দিয়ে মানুষের গালমন্দ করছো, অপবাদ, নিন্দা ও গিবত করে বেড়াচ্ছ! ওহে যে অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করছো, এসবকে তুচ্ছভাবে দেখছো ও মালিকদের কাছে তা ফিরিয়ে দিচ্ছো না। তুমি তওবা কর! তোমার রবের দিকে ফিরে এসো! দ্রুত পাওনাদারের অধিকার পরিশোধ করে দাও। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘চিরঞ্জীব, সর্বসত্তার ধারকের নিকট সকলেই হবে অধোবদন। আর সে-ই ব্যর্থ হবে, যে জুলুমের ভার বহন করবে।’ (সুরা ত্বাহা : ১১১)। আর্থিক বা মানসিক সব ধরনের জুলুম এ আয়াতের ব্যাখ্যার অন্তর্গত।
ঋণের দায়ে নেকি দান : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঋণ রেখে মারা যায়, তার ঋণ তার নেকি দ্বারাই আদায় করা হবে। তখন আর কোনো টাকা-পয়সা থাকবে না। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৪১৪)। তাই, তোমরা দ্রুত নিজেদের দায়মুক্ত কর। নিজের আত্মাকে রক্ষা কর, যাতে নিরাপদ ও সফল হও। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা অবশ্যই কেয়ামতের দিন ন্যায়সঙ্গতভাবে অধিকারগুলো তাদের মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেবে। এমনকি শিংবিহীন ভেড়াকেও শিংওয়ালা ভেড়ার জুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ দেয়া হবে।’ (মুসলিম: ৬৪৭৪)। একজন মুসলিমের ওপর অবশ্যকর্তব্য হলো, সে যেন পরিশ্রম করে মানুষের অধিকার থেকে নিজেকে মুক্ত করে। কারণ সহিহ হাদিসে এসেছে, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও গোনাহ মাফ করে দেয়, কিন্তু ঋণ মাফ করে না। ঋণকে অবহেলা করলে দুনিয়া ও আখেরাতে ভয়াবহ ধ্বংস ডেকে আনবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের কাছ থেকে সম্পদ নিয়ে তা ফেরত দিতে চায়, আল্লাহ তার পক্ষ থেকে ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। আর যে সম্পদ নিয়ে তা নষ্ট করার ইচ্ছা করে, আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দেন।’ (বোখারি : ২৩৮৭)।
(২৭-১০-১৪৪৬ হিজরি মোতাবেক ২৫-০৪-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন - আবদুল কাইয়ুম শেখ)