আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলমানদের ওপর এক বিশেষ রহমত হলো, তিনি তাদের ঈমানের পথে পরিচালিত করার পর সেই পথের নির্দেশনাও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। সেই পথ হচ্ছে শান্তির পথ, যে পথ তাকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছায় এবং যে পথে চললে মানুষ শরিয়তের ওপর অটল থাকতে পারে ও সোজাপথে অবিচল থাকতে সক্ষম হয়। ঈমানের সবচেয়ে বড় নিদর্শন ও প্রমাণ হলো, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইখলাস অবলম্বন ও মহানবী (সা.)-এর সুন্নাহর অনুসরণ। এই দুটি হচ্ছে ঈমানের শর্ত। এগুলো ছাড়া ঈমান সঠিক হয় না ও আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় না। আর সরল পথে টিকে থাকার শক্তিশালী উপায়ও এই দুটিই।
ঈমান মানে শুধু মুখে বলা নয়, বরং তা কথার সঙ্গে কাজের সমন্বয়ও। এটাই কোরআন ও রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা মুমিন ও সৎকর্মপরায়ণ তাদের প্রতিপালক তাদের ঈমানের কারণে তাদের পথনির্দেশ করবেন; সুখদ কাননে তাদের পাদদেশে নহরগুলো প্রবাহিত হবে।’ (সুরা ইউনুস : ৯)। এই মহান প্রতিশ্রুতির অধিকারী তারাই- যারা ঈমান এনেছে এবং সেই ঈমান অনুযায়ী একনিষ্ঠতার সঙ্গে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর অনুসরণে সৎকর্ম করেছে। এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করল, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আপনি আমাকে ইসলামের বিষয়ে এমন কিছু বলুন, যাতে আমি আর কারও কাছে কিছু জানতে না চাই।’ তিনি বললেন, ‘বলো, আমি আল্লাহতে ঈমান এনেছি, এরপর ঈমান অনুযায়ী আমলে স্থির থাক।’ (মুসলিম : ৬৪)। এই হাদিসটি নবী করিম (সা.)-এর সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর অর্থবহ কথাগুলোর অন্যতম। এটি ইসলামের মূলনীতিগুলোর একটি সারকথা। এখানে মহানবী (সা.) দ্বীনের পূর্ণ পথ দেখিয়ে দিয়ে অতি সংক্ষেপে আল্লাহর দিকে পৌঁছার পথ বলে দিয়েছেন।
হাদিসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘আল্লাহকে রব, সৃষ্টিকর্তা, সবকিছুর ব্যবস্থাপক ও পরিপূর্ণ গুণাবলির অধিকারী বলে বিশ্বাস করো। এরপর তোমার এই বিশ্বাসকে বাস্তবে প্রমাণ করো। তোমার দেহ-মন যেন সবসময় আল্লাহর আদেশ পালন করে, তার নিষেধ এড়িয়ে চলে এবং এই পথে তোমার স্থিরতা যেন অটল থাকে। এমন অটলতা যেন সারাজীবন বজায় থাকে, যাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতের ফেরেশতারা তোমার কাছে সুখবর নিয়ে আসে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা বলে, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, এরপর অবিচলিত থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় ও বলে, ‘তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না। তোমাদের যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তার জন্য আনন্দিত হও।’ (সুরা হামিম সিজদা : ৩০)। এই আয়াত প্রমাণ করে যে, আমল তখনই কবুল হবে, যখন ঈমান ও তাওহিদ শুদ্ধ হবে। কেননা, সঠিক তাওহিদ ছাড়া কোনো আমল গ্রহণযোগ্য নয়। তাওহিদই হচ্ছে আমলের মূলভিত্তি।
আল্লাহর প্রতি ঈমান যদি কারও অন্তরে সত্যিকারভাবে বসে যায়, তাহলে সে বাধ্য হয় একমাত্র আল্লাহর জন্য ধর্মকে খাঁটি করতে, তাঁর জন্য একনিষ্ঠভাবে সব কাজ করতে। এর অর্থ হলো, বান্দা তার প্রতিটি ইবাদতে একমাত্র আল্লাহরই সন্তুষ্টি কামনা করবে এবং সব নেক আমলের মাধ্যমে শুধু তাঁরই নৈকট্য অন্বেষণ করবে। এটিই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর বাস্তব রূপ। আল্লাহতায়ালার প্রতি সঠিক ঈমান মানুষের অন্তরে মহান আল্লাহর প্রতি গভীর ভক্তি ও শ্রদ্ধাবোধ, তাঁর প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ, নিখাঁদ ভালোবাসা, ভয় ও আশা জন্ম দেয়। এ কারণেই সব রকম ইবাদতে- হোক তা অন্তরের বা শরীরের- ইখলাস ও নিষ্ঠা থাকা অত্যন্ত জরুরি। ইখলাস বা নিষ্ঠাই সব ইবাদতের ভিত্তি ও মূল স্তম্ভ।
শুধু ইখলাস থাকলেই বান্দা আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে পারে না। সে তখনো পরিপূর্ণ ঈমানদার হয় না, এমনকি তাকে পুরোপুরি মুমিন বলা যায় না- যতক্ষণ না তার আমলগুলো আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী হয়ে যায়। কারণ তিনিই হচ্ছেন আল্লাহর প্রেরিত পথপ্রদর্শক রাসুল, তাঁকে মানা মানেই আল্লাহকে মানা। তিনিই আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন কোন কাজ আল্লাহর প্রিয়, কোনটি তিনি কবুল করেন ও কোনটি তিনি পছন্দ করেন। এটাই ‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ সাক্ষ্য দেওয়ার বাস্তবতা যে, আল্লাহর রাসুল হিসেবে মহানবী (সা.)-কে স্বীকার করা ও তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা। এই আনুগত্যই ইসলামে কাম্য। কেননা, ইসলাম মানে হলো, আল্লাহর প্রতি একত্ববাদের ভিত্তিতে আত্মসমর্পণ করা, তাঁর আদেশ মেনে চলা ও শিরক থেকে মুক্ত থাকা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কেউ রাসুলের আনুগত্য করলে সে আল্লাহরই আনুগত্য করল।’ (সুরা নিসা : ৮০)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘বলো, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস, তবে আমাকে অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন ও তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩১)। ইমাম আবু আমর আওজায়ি (রহ.) বলেন, ‘ঈমান তখনই সঠিক হয়, যখন তা কথার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। কিন্তু কথামাত্র যথেষ্ট নয়, আমলও থাকতে হবে। এই কথা ও কর্ম তখনই সঠিক হয়, যখন তা একটি সুন্নাহর সঙ্গে মিল থাকা নিয়তের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়।’
কেউ যদি আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ হয় ও তাঁর সন্তুষ্টি পাওয়ার উদ্দেশ্যেই শুধু ইবাদত করে, তারপর সে যদি আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর অনুসরণও করে, তাহলে যেন সে দ্বীনের নিম্নোক্ত দুই মূলনীতির সমন্বয় করে ফেলল যে- ১. আমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করি, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করি না। ২. তাঁর ইবাদত শুধু সেইভাবে করি, যেভাবে তিনি শরিয়তের মাধ্যমে আদেশ দিয়েছেন; নিজে বানানো কোনো বেদয়াত বা নতুন উপায়ে করি না।
এভাবেই সে সত্যিকারের মুসলিম হয়ে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের দলে চলে আসে। সে তাদের থেকে পৃথক হয়ে যায় যারা গোমরাহ, যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে শরিক করে, একনিষ্ঠতার অভাব রাখে অথবা এমনভাবে ইবাদত করে যেভাবে আল্লাহ আদেশ করেননি ও মহানবী (সা.) শেখাননি। তারা আসলে নিজেদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে। আল্লাহতায়ালা তাঁর মহাপবিত্র সত্তা সম্পর্কে বলেন, ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদের পরীক্ষা করার জন্যে যে, কে তোমাদের মধ্যে কর্মে সবচেয়ে উত্তম?’ (সুরা মুলক : ২)। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ফুজাইল ইবনে ইয়াজ (রহ.) বলেন, ‘সর্বোত্তম আমল’ অর্থ হচ্ছে- যেটি সবচেয়ে ইখলাসপূর্ণ ও সঠিক। যদি কোনো কাজ সঠিক হয়; কিন্তু একনিষ্ঠ না হয়, তাহলে তা কবুল হবে না। কবুল হওয়ার জন্য, কাজটি হতে হবে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য ও সুন্নাহ অনুযায়ী।’
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাহাবিরা আল্লাহর ইবাদত করতেন ঠিক সেভাবে যেমনভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের শিক্ষা দিয়েছেন। তাদের কাছে হালাল হলো- রাসুল যা হালাল করেছেন। হারাম হলো- যা তিনি হারাম করেছেন। দ্বীন মানে তারা বুঝতেন যাকে আল্লাহর রাসুল (সা.) শরিয়ত বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা নিয়মিতভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়তেন, রমজানের রোজা রাখতেন, হজ করতেন, যাকাত দিতেন, ভালো কাজের আদেশ দিতেন, মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করতেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করতেন ও রাসুলুল্লাহ (সা.) যেভাবে আদেশ দিয়েছেন সেভাবে ইবাদত করতেন। তারা শুধু আল্লাহরই ইবাদত করতেন, কারও কাছেই সাহায্য চাইতেন না- চাই সে আসমানের কেউ হোক বা জমিনের। না ফেরেশতা, না গ্রহ-নক্ষত্র, না কোনো নবী, না কোনো মূর্তি- কাউকেই তারা ডাকতেন না। তারা জানতেন, এগুলোর সবই আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কর্তৃক নিষিদ্ধকৃত শিরক। তারা কোনো সৃষ্টিকে ডাকতেন না- না ফেরেশতা, না জিন, না মানুষ; না জীবিত অবস্থায়, না কবরের পাশে, না অনুপস্থিত অবস্থায়। তারা শুধু আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইতেন, শুধু আল্লাহর ওপরই ভরসা রাখতেন, মাফ, হেদায়েত, বিজয়- সব কিছু শুধু আল্লাহর কাছেই চাইতেন।’
(১৬-০১-১৪৪৭ হিজরি মোতাবেক ১১-০৭-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- আবদুল কাইয়ুম শেখ)