ঢাকা বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৫ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দরুদের তাৎপর্য ও গুরুত্ব

রায়হান রাশেদ
দরুদের তাৎপর্য ও গুরুত্ব

দরুদ ফারসি শব্দ। অর্থ হলো শুভকামনা, কল্যাণ প্রার্থনা। দরুদ শব্দের আরবি হলো ‘সলাত’। সলাত শব্দের মূল চারটি অর্থ- দরুদ বা শুভকামনা, তাসবিহ বা গুণকীর্তন, রহমত বা দয়া-করুণা ও ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা। পরিভাষায় দরুদ বলতে ‘আস সলাত আলান নাবি’, অর্থাৎ নবীজির প্রতি দরুদ পাঠ বা তাঁর জন্য শুভকামনা, তাঁর গুণকীর্তন, তাঁর প্রতি আল্লাহর দয়া করুণা প্রার্থনা বোঝায়।

ইসলামি পরিভাষা মতে, ‘সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সন্তান-সন্ততির প্রতি আল্লাহতায়ালার দয়া ও শান্তিবর্ষণের জন্য প্রার্থনা করে যে বাক্য পাঠ করা হয়, তাকেই দরুদ বা সালাত বলা হয়।’ (স্যালুটেশনস অন আওয়ার ডিয়ার প্রফেট, খাজা মোহাম্মাদ জুবায়ের, খালিজ টাইমস, ০১ জুন ২০১৭)।

জগতের অধিশ্বর আল্লাহ আমাদের মালিক। আমরা তার গোলাম। আমরা তাঁর ইবাদত করি। তাঁর গুণকীর্তন গাই। তাঁর নামে তাসবিহ জপি। শুধু আমরা কেন- জগতের সব সৃষ্টিই তাঁর ইবাদত করে। তাঁর নামে আমল করে। তিনি কোনো আমল করেন না। তাঁর আমলের প্রয়োজনও নেই। তবুও তিনি একটি মাত্র আমল করেন। একজনের জন্য ভালোবাসার বার্তা পাঠান। আল্লাহতায়ালা প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠ করেন। কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা নবীর প্রতি দরুদ পাঠ করেন। হে ঈমানদাররা, তোমরাও তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করো এবং বেশি পরিমাণে সালাম পাঠ করো।’ (সুরা আহজাব : ৫৬)। প্রত্যেক ইবাদত এবং জিকির ও দোয়ার আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং আছে বিশেষ ফায়দা ও উপকারিতা, খায়ের ও বরকত। দরুদ শরিফর বৈশিষ্ট্য এবং এর বিশেষ উপকারিতা এই যে, দিলের গভীর থেকে অধিক পরিমাণে দরুদ পড়ার দ্বারা একইসঙ্গে লাভ হয় আল্লাহতায়ালার খাস রহমত, বিশেষ করুণা-দৃষ্টি ও মেহেরবানি এবং নবীজি (সা.)-এর রুহানি নৈকট্য, গভীর সম্পর্ক ও তাঁর অত্যধিক মায়া-মমতা! দরুদ শরিফ পাঠ করে অধম বান্দা হয়ে যায় মহামহিম আল্লাহতায়ালা ও তাঁর মহামর্যাদাবান আখেরি নবী- উভয়ের মাহবুব ও প্রিয়! দুনিয়া-আখেরাতে বান্দার এর চেয়ে বেশি আর কী চাই?

বান্দার ওপর আল্লাহর দরুদ পাঠ : আব্দুর রহমান ইবন আওফ (রা.) বলেন, ‘একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) বের হয়ে এক খেজুর বাগানে প্রবেশ করলেন। অতঃপর দীর্ঘক্ষণ সেজদা করলেন। এমন কি আমাদের ভয় হলো তাঁর মৃত্যু হয়ে গেল নাকি। আমি তাঁকে দেখতে আসলাম তখন তিনি মাথা উঠালেন এবং বললেন, তোমার কি হলো? আমি তাঁকে আমাদের ভয়ের কথা ব্যক্ত করলাম। তারপর তিনি বললেন, জিবরাইল (সা.) আমাকে বললেন, আমি কি আপনাকে এই সুসংবাদ দেব না যে, আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘যে ব্যক্তি আপনার ওপর দরুদ পাঠ করবে, আমি তার ওপর দরুদ পাঠ করব। আর যে ব্যক্তি আপনাকে সালাম করবে আমি তার ওপর শান্তি নাজিল করব।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৭)।

আল্লাহর নির্দেশ পালন : নবীজি (সা.)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠ করা আল্লাহর নির্দেশ। নবীজির প্রতি দরুদ পাঠ করলে আল্লাহর নির্দেশ পালন করা হবে। এই নির্দেশ পালন করা মুমিন-মুসলমানের জন্য ওয়াজিব। এতে আছে অফুরান সওয়াব। আছে প্রেমিকের কথামতো চলার আশিস। নবীজির প্রতি দরুদ পড়তে আল্লাহ আদেশ করেছেন। (সুরা আহজাব : ৫৬)।

কৃপণতার অভিশাপ : মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘সেই হচ্ছে কৃপণ, যার সামনে আমার নাম উচ্চারিত হয়েছে অথচ সে আমার ওপর দরুদ পড়েনি।’ (তিরমিজ : ৩৫৪৬)।

আরেক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের বলে দেব না, সবচেয়ে কৃপণ কে? সকলে বলল, অবশ্যই হে আল্লাহর রাসুল, তিনি বললেন, যার কাছে আমার নাম উল্লেখ করা হলো, অথচ সে আমার প্রতি দরুদ পাঠ করল না। সেই হলো সবচেয়ে বড় কৃপণ।’ (সহিহ আত-তারগিব : ১৬৮৪)।

ধ্বংস ডেকে আনা : কাআব বিন উজরা (রা.) ও অন্যান্য সাহাবি থেকে বর্ণিত, ‘একবার রাসুল (সা.) মিম্বারে আরোহণ করলেন। তিনি যখন মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে উঠলেন তখন বললেন ‘আমিন’। দ্বিতীয় সিঁড়িতে উঠেও ‘আমিন’ বললেন এবং তৃতীয় সিঁড়িতে উঠেও বললেন, ‘আমিন’! আমরা কারণ জিজ্ঞাসা করলে নবীজি (সা.) জবাবে বললেন, মিম্বরে আরোহণের সময় আমার কাছে জিবরাইল (আ.) এলেন (এবং তিনটি বদদোয়া করলেন, আর আমি তাঁর প্রত্যেক বদদোয়ার ওপর ‘আমিন’ বললাম)। আমি যখন প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলাম, তিনি বললেন, ওই ব্যক্তি কল্যাণপ্রাপ্ত না হোক, যে রমজান মাস পেল। তারপরও তার গোনাহ ক্ষমা করা হলো না। আমি বললাম, ‘আমিন’! যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলাম, তিনি বললেন, ওই ব্যক্তি কল্যাণপ্রাপ্ত না হোক, যার কাছে আপনার নাম উল্লেখ করা হলো। তা সত্ত্বেও সে আপনার প্রতি দরুদ পড়ল না। আমি বললাম, ‘আমিন’! তৃতীয় সিঁড়িতে উঠলে তিনি বললেন, ওই ব্যক্তিরও কল্যাণ না হোক, যে পিতা-মাতার উভয়কে বা তাদের একজনকে বার্ধক্যে উপনীত পেল। কিন্তু তারা তার জন্য জান্নাতে প্রবেশের কারণ হলো না (অর্থাৎ সে তাদের খেদমত করে জান্নাত কামাই করতে পারল না)। আমি বললাম, ‘আসিন’!’ (আল-আদাবুল মুফরাদ, বোখারি : ৬৪৪)।

দূরবর্তীদের দরুদ পৌঁছানো হয় : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মহান আল্লাহর নির্ধারিত একদল ফেরেশতা রয়েছেন, যারা দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ান এবং আমার উম্মতের সালাম আমার কাছে পৌঁছে দেন।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান : ৯১৪)।

নিকটবর্তীদের দরুদণ্ডসালাম শোনেন : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে আমার কবরের পাশে আমার ওপর দরুদ পেশ করে, আমি তা শুনি। আর যে দূরে থেকে আমার ওপর দরুদ পড়ে, তা আমার কাছে পৌঁছানো হয়।’ (ফাতহুল বারি : ৬/৬০৫)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) সালামের জবাব দেন : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যেকোনো ব্যক্তি যখন আমার ওপর সালাম পেশ করে, তখন আল্লাহ আমার মধ্যে আমার আত্মা ফিরিয়ে দেন। ফলে আমি তার সালামের জবাব দিই।’ (আবু দাউদ : ২০৪১)।

লেখক : আলেম ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত