প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
হেলাল একজন সাহাবির নাম- আল্লাহতায়ালা তার প্রতি সন্তুষ্ট হোন। সে ছিল রাখাল। একজন রঈস মুসলমানের ঘরে তিনি ঘোড়া আর গবাদিপশুর দেখাশোনা করতেন। তিনি ছিলেন আল্লাহর খাস বান্দা, দূরদর্শী- তবে নিজেকে গোপন রেখেছিলেন রাখালির আড়ালে। যেমন লোকমান (আ.) ও ইউসুফ (আ.) আত্মগোপন করেছিলেন দাসত্ব পেশার আবরণে। হেলালের রঈস মুসলমান হলেও অন্তর্গত দিক থেকে ছিলেন অন্ধ। আর হেলাল কৃতদাস হয়েও ছিলেন আলোকিত হৃদয়। হেলাল কৃতদাস ছিলেন বটে; কিন্তু আত্মিকভাবে ছিলেন প্রতিমুহূর্তে অগ্রসরমান।
হেলালের অবস্থা তোমার মতো ছিল না। নৈতিক আত্মিকভাবে তুমি আগোয়ান হওয়ার পরিবর্তে শুধু পেছনের দিকেই যাও। তোমার মধ্যে অতি মূল্যবান রত্ন গচ্ছিত, অথচ সেই মণিরত্নকে মামুলি পাথরে পরিণত করার জন্য হেন কাজ নেই যা তুমি করছ না।
তোমার অবস্থা সেই মেহমানের মতো, যে একজন সম্ভ্রান্ত মানুষের ঘরে মেহমান হয়। আলাপচারিতায় মেজবান তার কাছে জানতে চায়, বল তো তোমার বয়স কত? বলল, আমার বয়স ১৮, হয়তো সতের কিংবা ১৬ বা ১৫-এর মতো হতে পারে। মেজবান বলল, তুমি যেভাবে পেছনের দিকে যাচ্ছ, তাতে তুমি এখনো মায়ের কোলে। হ্যাঁ, শৈশবের ছেবলামী এখনো তুমি ছাড়তে পারনি।
জীবনকে সার্থক করার কার্যকর কোনো পথ তুমি খুঁজে নাওনি। তোমার মধ্যে গচ্ছিত আমানত প্রতিভা, মেধা, মনন, সুন্দর চরিত্রের স্ফূরণের পরিবর্তে শুধু পশুত্ব ও পতনের দিকেই যাচ্ছ। কথা ছিল সুন্দর চিন্তা, সৎকর্ম, উন্নত স্বভাব দিয়ে ভেতরের রত্নটিকে উজ্জ্বল করবে, সে কথা ভুলে গেছ, পরিবর্তে ডুবে আছ দুনিয়ার নর্দমায়। এভাবে পতনের দিকে তলিয়ে যাওয়ার পরিণতি কী হবে কখনও কি ভেবে দেখেছ?
তুমি বলতে পার, আমার মধ্যে যে নফসে আম্মারা সেটিই আমাকে সৎপথে চলতে দিচ্ছে না। শোনো, এক লোক কোনো রঈসের কাছে গিয়ে ধর্ণা দিল, আমাকে একটি ঘোড়া দেন বাহন হিসেবে বাড়ি যেতে চাই। রঈস বললেন, মাটির রঙের ওই ঘোড়াটি নিয়ে যাও বাহনরূপে। বলল, এই ঘোড়া আমি চাই না। এটি অবাধ্য, আমার আদেশ মানবে না, তার গতি পশ্চাতমুখী। আগেও দেখেছি, যতই সামনে হাঁকাই, শুধু পেছনের দিকে যায়। রঈস বললেন, তাহলে একটা কাজ কর, যখন ঘোড়ায় চড়বে, লেজটা রাখবে তোমার ঘরের দিকে। তাহলে যখন পেছন দিকে যেতে থাকবে, তোমাকে তোমার ঘরে পৌঁছিয়ে দেবে। তার মানে কি শোনো।
তোমার মনের কামনা-বাসনা যদি পতনের দিকে নিয়ে যায়। আর তুমি চাও তাকে আত্মিক উন্নতির পথে নিতে তাহলে তোমার নফসের ঘোড়ার লেজটা ঘুরিয়ে দাও পরকালীন বিষয়াদির দিকে। শোনো, তোমার কামনা-বাসনার মুখে যদি জোঁয়াল পরাও, দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতার দিক থেকে যদি মন ফিরিয়ে নাও, সেই কামনা-বাসনাই তোমাকে নিয়ে যাবে উন্নত চিন্তা ও বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগানোর দিকে।
ব্যাপারটি হবে গাছের বাড়তি ডালপালা কাটার মতো। তোমার মনের গাছটা ছাঁটাই কর, তাহলে মূল ডালপালা শক্তি পাবে, ফলবান হবে। কাজেই হে হাকিকতের সন্ধানী, তোমার মনের কামনা বাসনাকে দুনিয়ার পচা দুর্গন্ধ থেকে সরিয়ে রাখ আর তা নিয়োজিত কর তোমার আত্মিক উন্নতির কাজে। তখন দেখবে তোমার নফসের ঘোড়া বশীভূত হয়ে গেছে। এমন নফসের উপমা বাধ্য ঘোড়ার মতোই।
সে পেছনে যেমন ধায় না, তেমনি অবাধ্য উচ্ছৃঙ্খলও হয় না। ওহে হাকিকতের সন্ধানী, তোমার মনের বাহন প্রস্তুত কর। তীব্রবেগে চলো তোমার আত্মিক উন্নতির দিকে। মুসা কলিমুল্লাহর মতো হোক তোমার চলার গতি। তাহলে ২৭ বছরের পথ তুমি এক রাতে অতিক্রম করে খিজিরের সন্ধান পাবে। যার বিবরণ কোরআন মজিদে ১৫-১৬ পারায় উল্লেখ আছে।
শাহসওয়ারান দর সেবাকত তাখতান্দ
খারবাতান দর পায়েগাহ আন্দাখতান্দ
ঘোড়সওয়াররা প্রতিযোগিতায় ছাড়িয়ে গেছে
অলসের দল আস্তাবলে ভাগ্যহত পড়ে আছে।
একজন মুসাফির গ্রামে এক বাড়িতে পৌঁছে বলল, আমি ভিনদেশি মুসাফির, কটা দিন থাকতে চাই মেহমান হয়ে। ভেতর থেকে বলা হলো, আগে গাট্টিবোচকা বাইরে নামিয়ে রাখো, তারপরে এই ঘরে প্রবেশ করতে পার। হ্যাঁ, তোমার আমিত্ব, অহমিকা, বড়াই, বুজুর্গী, কামনা-বাসনা, ভোগের লিপ্সা, জৈবিক ক্ষুধা যতদিন না ছাড়বে, ততদিন জায়গা হবে না তোমার মহান প্রভুর মজলিসে।
হেলাল ছিলেন স্বচ্ছ অন্তরের সাচ্ছা মুমিন। যদিও তার বাহ্যিক পরিচয় ছিল তিনি একজন কৃতদাস, গবাদিপশুর রাখাল। আল্লাহর অনেক অলি আছেন আত্মগোপনে সাধারণ মানুষের ছদ্মাবরণে। যাদের দৃষ্টিভঙ্গি ইবলিসের তারা চিনতে পারে না ফকিরবেশি এসব শাহানশাহদের। আদম (আ.)-এর বেলায় ইবলিস শুধু আদমের বাইরের কায়া দেখেছিল। কায়ার ভেতরে কী অমূল্য রত্ন ছিল তা বুঝার সাধ্য তার ছিল না। তাই বলেছিল, ‘আমি কেন আদমকে সেজদা করব। তুমি তাকে বানিয়েছ মাটি দিয়ে আর আমাকে সৃষ্টি করেছ আগুন থেকে। আগুনের ধর্ম ঊর্ধ্বগামী হওয়া আর মাটির ধর্ম নিচের দিকে যাওয়া। আদমকে চিনতে ইবলিসের বিভ্রাটের কারণ ছিল, মাটির রং দেখা যায়; কিন্তু দ্বীনের নুর দেখা যায় না। আল্লাহর পয়গাম্বররাও দুনিয়াতে এভাবেই ছিলেন। তাদের বাইরের অবয়ব দেখেছে কাফেররা, দেখেনি তাদের হৃদয়ের স্বচ্ছতা, বিশালতা।
মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির এই পার্থক্য স্তরভেদে ভিন্ন ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ এক লোকে ওপরে তাকিয়ে দেখে একটি সুউচ্চ মিনার। মিনারের ওপর যে সুন্দর পাখি বসে আছে তা সে দেখেনি। আরেকজন দেখল, মিনারের ওপর বসে আছে একটি সুন্দর বাজপাখি। দ্বিতীয় ব্যক্তি মিনারের ওপর বসা দুরন্তবাজ দেখল বটে; কিন্তু বাজের ঠোঁটে সুতার মতো এক চিলতে খড় দেখতে ব্যর্থ হলো সে। বস্তুত হাকিকতকে চিনতে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির এই তারতম্য চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। তবে-
ওয়ানকে উ ইয়ানজুর বি নুরিল্লাহ বুয়াদ
হাম যে মোর্গ ও হাম যে মু আগাহ বুয়াদ
যার আছে আল্লাহর নুরে দেখার দিব্য নজর
সে দেখে মিনারে বসা পাখি ও ঠোঁটের খড়।
ঘটনাক্রমে হেলাল (রা.) অসুস্থ ছিলেন। এক দুই দিন নয়, টানা ৯ দিন বেহাল পড়ে থাকেন আস্তাবলে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর রহমত তার সহায় হয়। অহি আসে প্রিয় নবীজির কাছে। তিনি রওনা হলেন প্রিয় সাহাবির খোঁজ নিতে। খবর পেয়ে একদল সাহাবি রওয়ানা হলেন সঙ্গে। হেলালের রঈস জানতে পারলেন সৃষ্টির সেরা আল্লাহর পেয়ারা হাবিব আসছেন তার বাড়িতে। তিনি আনন্দে আত্মহারা। সালাম শ্রদ্ধায় নবীজিকে স্বাগত জানায় প্রাণ উজাড় করে। বলে, আপনার শুভাগমনে আমার এই গরিবালয় আজ বেহেশতের কানন। আপনার জন্য উৎসর্গিত আমার প্রাণ জীবন। কীভাবে আপনি তশরিফ আনলেন এই গরিবের বাড়িতে। আপনার কদমে আমার মা-বাবা উৎসর্গিত হোক। নবীজি বললেন, আমার হেলাল কোথায় বলো। আমি আসিনি তোমার কাছে। এসেছি হেলালের খোঁজে। আমার হেলাল অসুস্থ, এখন কোথায় আছে? রঈস বলল, হে আল্লাহর নবী! আমি তো জানি না হেলাল অসুস্থ। তবে কদিন থেকে তাকে দেখি না। সে আমার ঘোড়া ও পশুগুলো দেখে। আস্তাবলের এক কোণায় থাকে। নবীজি এগিয়ে গেলেন হেলালের কাছে। অন্ধকার ঝুপড়িতে শায়িত হেলালের ঘুম ভাঙে নবীজির সুবাসে। ইউসুফের সুবাসে যেভাবে পিতা ইয়াকুব হারানো দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান হেলালেরও ঘুম ভাঙল, হৃদয় আলোকিত হল নুর নবীর সুবাসে, জ্যোতির পরশে।
মওলানা রুমির অন্যতম জীবন দর্শন সমজাত আকর্ষণ। তার মানে প্রত্যেকের মনে যে ক্ষুধা থাকে তা যদি কারও চরিত্রে আচরণে দেখে সেদিকেই আকৃষ্ট হয়। নবীজির প্রতি যারা ঈমান এনেছে তারাও নবীজির চরিত্রে তাদের মনের সৌন্দর্যের প্রতিফলন দেখে মুসলমান হয়েছে। তারা মুজেজা বা অলৌকিককাণ্ড দেখে মুগ্ধ হয়ে ঈমান আনেনি। ঈমান এনেছে মনের টানে। তার মানে মনের লালিত চিন্তার সঙ্গে নবীজির শিক্ষা ও স্বভাবের মিল খুঁজে পেয়ে সত্যের আকর্ষণে ঈমান এনেছে। নচেত আলৌকিকত্ব দেখানো হয়েছে কাফেরদের জব্দ করার জন্য। ঈমান জোরজবরদস্তির বিষয় নয়; ঈমানের খুশব নেওয়ার নাসিকান্দ্রীয় যাদের আছে তারাই নবীজির মহব্বতের খুশব পায়। হেলাল চোখ মেলে দেখেন পূর্ণিমা চাঁদ উদিত হয়েছে আজ আস্তাবলের গহীন কোণে। তার চেহারা লুটিয়ে পড়ে নবী মুস্তফার পায়ে। নবীজি তাকে টেনে তুলে মুখে চুমোর পর চুমো এঁকে দিলেন। জানতে চাইলেন, হেলাল, তুমি কেমন আছ। হেলাল (রা.) বললেন, আমার অবস্থা সেই ঘুমন্ত কুকুরের মতো, যে জেগে উঠে দেখে, নিজে বাঘে পরিণত হয়েছে। আমি সেই অন্ধ ব্যক্তির মতো, যে পথ হাতড়িয়ে চলছিল, হঠাৎ চোখ মেলে দেখে এক সবুজ শ্যামল বাগানে পায়চারি করছে।
হ্যাঁ, প্রতিটি মানুষ হেলালের মতো। হেলাল মানে নতুন চাঁদ। নতুন চাঁদ চিকন হলেও তার ভেতর লুক্কায়িত পূর্ণিমা চাঁদ। নতুন চাঁদকে প্রথমে দেখা যায় অপূূর্ণরূপে। ক্রমে তা অগ্রসর হয় পূর্ণতার দিকে। ইসলামের শিক্ষার আলোকে সাধনার বলে মানুষের সম্মুখের পর্দাগুলো সরে যায়। তখন উদ্ভাসিত হয় পূর্ণিমা চাঁদনি রূপে। হ্যাঁ বহু বছর চেষ্টা সাধনার কষাঘাতে জর্জরিত হতে হবে, দুঃখ-কষ্ট সয়ে ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে, তাহলেই পূর্ণতা অর্জন করতে পারবে। যারা রাতারাতি পূর্ণতায় পৌঁছতে চায়, সাধানার সিঁড়ি অতিক্রম না করে পূর্ণতার মহড়া দেখায় অচিরেই তাদের অপরিপক্কতা ফাঁশ হয়ে যায়। বর্ণিত আছে, আদমের কায়া সৃষ্টি করা হয় ৪০ দিনে। এর পেছনে রহস্য হলো, ধীরে ধীরে ক্রমান্বয়ে মানুষকে পরিপক্বতা অর্জন করতে হবে। মানব শিশুও মাতৃগর্ভে কাটায় দীর্ঘ ৯ থেকে ১০ মাস। এর পেছনেও কারণ একটাই। কাজেই তুমি মনে করো না যে, একদিনে তুমি জীবনে সাফল্য ছিনিয়ে আনতে পারবে। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : ৬, বয়েত : ১১১১-১২২১)
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)