ঢাকা শনিবার, ৩১ মে ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব-৩)

তুষার বনে ভিন্ন মানুষ

আলম শাইন
তুষার বনে ভিন্ন মানুষ

নিকোলাস ডি সিলিভা বছরে অন্তত একবার হলেও ব্যবসায়িক কাজে ইয়াকুটস্কে যাতায়াত করে; উপাল সেনানায়েকে এবারই প্রথম যাচ্ছে। তারা সপ্তাহখানেক ইয়াকুটস্কে কাটিয়ে স্বল্প মূল্যে কিছু ডায়মন্ড ও এমিথিস্ট সংগ্রহ করে মস্কো ফিরবে; এমনটাই পরিকল্পনা তাদের। সাইবেরিয়ার এমিথিস্ট বা পদ্মনীলা জগৎখ্যাত রত্ন। মস্কোতে এই রত্নের ব্যাপক চাহিদা। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দুজন দায়িত্ব নিয়ে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছে। নিকোলাস সাহসিকতার সঙ্গে সাইবেরিয়ার প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে স্টোন এনে উপালের জেমস্টোনের দোকানে সরবরাহ করছে। নিকোলাস ডি সিলভা শ্রীলঙ্কার ‘রত্নপুরা’ জেলার বাসিন্দা। বহু বছর ধরেই সে তার পারিবারিক ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত। আসলে শ্রীলঙ্কার রত্নপুরা জেলার অভিজাত পরিবারের ব্যবসাই হচ্ছে রত্ন পাথরের। যা অত্র অঞ্চলের লোকজনের কাছে খানদানি ব্যবসা হিসেবে পরিচিত।

একসময় নিকোলাস নিজেও রত্নখনির ইজারাদার ছিল। কয়েক বছর আগেও সে শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন অঞ্চলে খনি ইজারা নিয়ে শ্রমিক লাগিয়ে কাঁচামাল সংগ্রহ করত। পাইকারি দামে কাঁচামাল বিক্রি করে অল্প বয়সে বেশ সম্পদ অর্জন করেছিল। ব্যবসাটা নিকোলাস বেশি দিন চালিয়ে যেতে পারেনি এলাকার চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে। এমনকি কয়েকবার ওদের হাতে হেনস্তার শিকারও হয়েছে নিকোলাস। একবার তো প্রাণ হারাতেই বসেছিল সে।

ঘটনার পর পরই সে বুঝতে পারে, এই ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। পরিবারের পক্ষ থেকেও চাপ আসে খনির ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার জন্য। শেষে অনেকটাই বাধ্য হয়ে ব্যবসাটা ছেড়ে মস্কোতে পাড়ি জমায় এবং মস্কো এসে নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করে। শ্রীলঙ্কার তুলনায় মস্কোতে এখন তার ব্যবসা ভালো জমেছে। ফলে মস্কোর মতো ব্যয়বহুল একটা শহরে পরিবার নিয়েই বসবাস করছে নিকোলাস ডি সিলভা।

নিকোলাস সাইবেরিয়ার পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা থেকেও দুর্লভ রত্নপাথর আমদানি করে। এর জন্য অবশ্য তাকে সবসময় শ্রীলঙ্কা অথবা ইয়াকুটস্কে যাতায়াত করতে হয় না, ওখানকার লোকজনের মাধ্যমেই রত্নপাথর সংগ্রহ করে। কাজটার জন্য তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হচ্ছে এটাও সত্যি। তাছাড়া কাজটা বেশ কঠিনও। মস্কোর স্থানীয়রা এতটা ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করতে আগ্রহী নয়। সে সুযোগটাকেই কাজে লাগাচ্ছে নিকোলাস ডি সিলভা। উপাল সেনানায়েকে সেটা উপলব্ধি করতে পেরেই নিকোলাসের পার্টনারশিপ হয়েছে। তাতে অবশ্য দুজনই লাভবান হচ্ছে।

উপাল সেনানায়েকে এর আগে সাইবেরিয়ায় আসেনি। তবে রাশিয়ার দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে বহুবার ঘুরে বেড়িয়েছে এটা সত্য। এখনও যেকোনো ট্রাভেল এজেন্সি থেকে দুর্গম যাত্রার অফার পেলে তারা লুফে নেয়। তাদের কাছে দুর্গম পথ মানেই নতুন অভিজ্ঞতা। তেমনি এবারও তারা যাত্রা করেছে সাইবেরিয়ার দুর্গম অঞ্চলে।

কয়েক দিন ধরে নিকোলাসের শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। সর্দি জ্বরে আক্রান্ত সে। উপাল সেনানায়েকে বলল, ‘তোমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, তাই সাইবেরিয়ায় বেশি দিন না কাটিয়ে দ্রুত মস্কো ফিরে গেলেই ভালো হয় নিকোলাস।’

উপাল সেনানায়েকের কথা শুনেই নিকোলাস ডি সিলভা রেগে গেল। কর্কশ কণ্ঠে বলল, ‘এসব না বললে হয় না উপাল। গন্ত্যবে না পৌঁছাতেই তুমি ফিরে যাওয়ার বায়না ধরেছ। বিষয়টা বুঝতে পারলাম না, তাছাড়া তোমার মতিগতিও ভালো ঠেকছে না।’

বন্ধু চটে যেতেই উপাল সেনানায়েকে নরম সুরে বলল, ‘তোমার স্বাস্থ্যের চিন্তা করেই কথাটা বললাম। যদি কষ্ট বাড়ে তাহলে সাইবেরিয়ায় বেশি দিন থাকব না।’

‘চমৎকার সিদ্ধান্ত নিয়েছ বন্ধু; ভাবছ আমি কিছুই বুঝিনি। আমার শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে অত ভাবতে হবে না তোমাকে; আপাতত ভালোই আছি। শোন উপাল, আগেও কয়েকবার এসেছি; কিন্তু একা একা কখনও দুর্গমে যাওয়ার সাহস করিনি। এবার দুজন একত্রে ভ্রমণে আসায় মনে সাহস পাচ্ছি; তাই নিশ্চিন্তে ঘুরতে পারব বলে আমার বিশ্বাস আছে। আরেকটা কথা, ফেরার সময় কিছু আনকাট ডায়মন্ড স্বল্পমূল্যে কিনে মস্কোতে ফিরব, এতে আমাদের বেশ লাভ হবে। মনে রেখো, এই লাভের অঙ্ক তুমি কল্পনাও করতে পারবে না; কথাটা আগেভাগেই বলে রাখলাম।’

উপাল হেসে বলল, ‘লোভ দেখাতে হবে না। নরকে গেলেও পাশে পাবে আমাকে।’ ‘উপাল, তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। শুনেছি বৈকাল পর্বতমালায় আসল আনকাট এমিথিস্ট পাওয়া যায়। বাজারে যেগুলো বিক্রি হয়, তার বেশিরভাগই নকল, আর কোয়ালিটির দিক থেকেও নিম্নমানের। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, এই ব্যবসাটা রাশিয়াজুড়ে পুরোপুরি বৈধ। এখন যদি সুযোগটা হাতছাড়া করি, পরে ভীষণ আফসোস করতে হবে আমাদের।

উপাল সেনানায়েকে অবাক হয়ে বলল, ‘এর জন্য পর্বতের গহিনে গিয়ে স্টোন সংগ্রহ করতে হবে না কি! মাথাটাথা ঠিক আছে তোমার?’ নিকোলাস হেসে বলল, ‘দুর্গম অঞ্চল থেকে আনকাট নিতে পারলে সত্তর শতাংশ কম দামে পাওয়া যাবে। বুঝলে কেন বলেছি, এতে প্রচুর লাভ হবে!’

‘বুঝতে পেরেছি সব, পাশাপাশি তোমার সাহস দেখে অবাকও হচ্ছি হিম ঠান্ডার মধ্যেও দুর্গমে যাওয়ার চিন্তা করছো জেনে। এতটা ঝুঁকি নেওয়া কি ঠিক হবে নিকোলাস! দুর্গমে গেলে বিপদেও তো পড়তে পারি আমরা; বিষয়টা মাথায় রেখো নিকোলাস।’

‘কিছুক্ষণ আগেও বলেছ, নরকে গেলেও সঙ্গে থাকবে। দুর্গমের কথা শুনেই এখনই কেটে পড়ার ধান্ধা করছ, ব্যাপারটা কি! তুমি যাও কিংবা না যাও সেটা বড় কথা নয়, দুর্গমে গেলেই যে বিপদে পড়ব, এমনটা ভাবছ কেন? বিপদ হলে বিমানেও হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমরা যাচ্ছি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরতে। মালভূমির আদিবাসীদের জীবনযাত্রা স্বচক্ষে দেখে ফিরে আসব। এতে বিপদের কিছু দেখছি না তো।’

উপাল সেনানায়েকে মৃদু হেসে বলল, ‘কৌশলে আমার আগ্রহটা জাগিয়ে তুলছ দেখছি। তবে একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, হাড় হিম করা ঠান্ডায় ঘুরে বেড়াবে কিভাবে!’

নিকোলাস ডি সিলভা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ওখানে ইয়াকুটস্ক শহরের তুলনায় ঠান্ডা অনেকটাই কম। চিন্তার কিছু নেই; তাঁবু, ফায়ারপ্লেস, মোটা জামা-কাপড়, শুকনো খাবারসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু সঙ্গে নেবো। তুমি দুশ্চিন্তা করো না।’

উপাল গম্ভীর স্বভাবের মানুষ। কথাবার্তাও কম বলে, তবে সবসময় সতর্ক থাকে। তার পঞ্চম ইন্দ্রিয় অন্যদের চেয়ে একটু বেশি সজাগ। মাঝে মাঝে সে এমন কিছু কথা বলে ফেলে, যা ভবিষ্যতে কোন না কোন ভাবে মিলে যায়। যদিও সে কোনো জ্যোতিষী নয়, তবে পরিচিতরা তার কথায় রহস্য খুঁজতে পছন্দ করে।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে উপাল বলল, ‘তাঁবুতে রাত কাটানোর সিদ্ধান্তটা পাল্টে ফেল। আমরা প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকতে অভ্যস্ত নই। বিমান থেকে নেমেই তুমি আগে খোঁজখবর নিয়ে দেখো ওখানে কোনো আবাসন ব্যবস্থা আছে কী না, যদি থাকে তাহলে আজই বুকিং দাও।’ চলবে...।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত