দেশ্যব্যাপী কুষ্টিয়ার কুলফি মালাইয়ের মিষ্টি স্বাদের সুখ্যাতি সুনাম রয়েছে আকাশচুম্বি। কুষ্টিয়ার কুমারখালির শিলাইদহসহ বিভিন্ন অঞ্চল হয়ে ওঠে কুলফি গ্রাম কিংবা কুলফিওয়ালার গাঁ। এই ঐতিহ্যেরই বাহক কুমারখালী উপজেলার নন্দলালপুর-সদরপুর গ্রামের বাসিন্দা আম্বিয়া খাতুন ও তার স্বামীর নাম আবদুল ওহাব। এক সময় সংসারের অভাব-অনটন সামাল দিতে হিমশিম খেতো আব্দুল ওহাব। মা বাবা ভাই বোনকে নিয়ে কোন মতে চলতো ওহাবের সংসার। বিয়ে করেন সদরপুর গ্রামের আম্বিয়া খাতুনকে। আম্বিয়া খাতুন বলেন, বাপ-চাচারা সবাই এলাকায় কুলফির ব্যবসা কইরতি। তাদের দেইখি শিখি ফেলিছিলাম। স্বামীর বাড়িত আসার পর সেই শিখা কাজে লাগাইছি। স্বামীক শিখাইছিলাম। এখন আস্তে আস্তে সংসারে উন্নতি করছি। সংসারে সুদিন আসার বিষয়ে আবদুল ওহাব তার পুরো কৃতিত্ব স্ত্রী আম্বিয়াকে দিয়ে বলেন-কুলফি বানানোর ওস্তাদ আমার স্ত্রী আম্বিয়া খাতুন। আমি শুধু বেচাবিক্রি করি। ওহাবের বয়স এখন ৬২ বছর। তিনি প্রায় ৩২ বছর ধরে কুলফি মালাই তৈরি ও নিজে ফেরি করে বিক্রি করেন। সরেজমিন কুলফি তৈরি দেখতে যাওয়া হয় সদরপুর গ্রামে। খুব সকালেই কুলফি মালাই ছাঁচে ভরে মুখ আটকানো হয়। সদরপুর গ্রামে কুলফি ওহাবের নামডাক সবার চেনাজানা। গ্রামের লোকজন দেখিয়ে দিলেন কুলফি ওহাবের বাড়ি। আধা পাকা বাড়ির ভেতর ও বাইরে পরিপাটি রং করা। বাড়িতে রয়েছে ৭টি গরু ও ৫টি ছাগল। মাঠে রয়েছে বিঘা দুই জমি। চার মেয়ে, এক ছেলের সংসারে তিন মেয়ে ও ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। সবই করেছেন কুলফি বিক্রির টাকায়। ১৫ বছর আগেও খড়ের ঘর ছিল। ছিল পাটকাটির বেড়া। জায়গাজমিও ছিল না জানিয়ে আবদুল ওহাব বললেন, এখন আমি খুবই ভালো আছি। প্রতিদিন ফেরি করে কুলফি বিক্রি করি। বাইনাও পায় অনেক। সকাল সাতটায় ছাঁচে কুলফি ভরার আগে কড়াভর্তি দুধ ঘরের বারান্দায় নিয়ে আসেন ওহাব। কুলফি তৈরি হয় যেভাবে জানালেন ওহাব-কুলফি তৈরির জন্য গরুর দুধ এলাকা থেকেই কেনেন। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দুধ জ্বালাতে থাকেন। গাঢ় হয়ে গেলে সন্ধ্যার পর সেই দুধ কড়াইয়ে করে ঘরের ভেতর রাখেন। সারা রাত ঠান্ডা হলে পরের দিন সকালে তার ভেতর চিনি মেশান। প্রতি এক মণ জ্বালানো দুধে দুই কেজি চিনি মেশান। এর পর স্বাদ ঠিক আছে কি না, সেটা দেখে দেন।
এতে সহযোগিতা করেন ছেলের বউ সীমা খাতুন। মুখে দিয়েই বললেন-আব্বা, ঠিক হইয়াচে। ছাঁচে কুলফি ভরা হয়ে গেলে এর পর মুল কারিগর স্ত্রী আম্বিয়া খাতুন আটা ও চুন দিয়ে তৈরি একধরনের আঠা দিয়ে ছাঁচের মুখটা ভালো করে আটকে দিচ্ছেন। তাতে সহযোগিতা করছিলেন ওহাবের বোন মনোয়ারা বেগম। এক মণ দুধে ১০ থেকে ১২ কেজি মালাই হয়। ছাঁচ রয়েছে ৩০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। মালাইভর্তি ছাঁচগুলো হাঁড়িতে করে পার্শ্ববর্তী আলাউদ্দিননগরে নিয়ে যান। সেখানে বরফ কল থেকে বরফ কিনে হাঁড়ির ভেতর নিয়ে মালাই ঠান্ডা করেন। কয়েক ঘণ্টা পর সেগুলো বিক্রির জন্য প্রস্তুত হয়। গরমকালে সবচেয়ে বেশি কুলফি বিক্রি হয় জানিয়ে ওহাব বললেন, এই সময়ে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার কুলফি বিক্রি করেন। এখানো অল্প অল্প ঠান্ডা পড়ছে, তাই বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে।
তবে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে বায়না পান। তৈরি করে সেসব জায়গায় কুলফি পাঠান। ছেলে রাকিবুল ইসলাম বললেন, এলাকা থেকে দুধ সংগ্রহ করা হয়। কুলফি বেচা বিক্রিতে সহযোগিতা করা হয়। বিশেষ করে অর্ডার নেয়া কুলফি শহরে পৌঁছে দেয়া হয়। কুলফির মান ভালো রাখা হয় বলে চাহিদাও বেড়েছে। কুলফিওয়ালা আব্দুল ওহাব প্রতিদিনই গড়াই সেতুর (সৈয়দ মাছ উদ রুমী সেতু) ওপর এক পাশে বসে বিক্রি করেন নিজেদেও তৈরি মিষ্টি স্বাদেও কুলফি মালাই। গড়াই সেতু দিয়ে যাদের চলাচল রয়েছে তারা সবাই কম-বেশি ওহাবের কুলফি মালাইয়ের স্বাদ নিয়েছেন। এখানেই নিয়মিত কুলফি মালাই বিক্রি করেন আব্দুল ওহাব কুলফিওয়ালা।