ঢাকা শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কলমাকান্দার পাহাড়ি সৌন্দর্যে মায়ার টান

কলমাকান্দার পাহাড়ি সৌন্দর্যে মায়ার টান

পাহাড় ও লেক ঝরনার অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধতা ছড়ানো মেঘালয় সীমান্তঘেঁষা নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুড়া, খারনৈ ও রংছাতি ৩টি ইউনিয়ন।

লেঙ্গুড়া বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তবর্তী জেলা নেত্রকোনার কলমাকান্দা থানার অন্তর্ভুক্ত একটি ইউনিয়ন। যার উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য ও সুবিস্তীর্ণ গাছপালা ও প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ একটি পাহাড়ি জনপদ। খুব কাছে থেকে মেঘালয়ের পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো একটি মনোরম স্থান লেঙ্গুড়া। এখানকার মনোরম পরিবেশ পর্যটকের মনকে নিশ্চয়ই কেড়ে নিবে। কাজেই বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে এখানে একটি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন এলাকাবাসী। এরইমধ্যে একটি ব্যক্তি উদ্যোগে এক রিসোর্ট সেন্টার চালু আছে। ফুলবাড়ি অম্বলিকা গ্রামের রিসার্টটি যেনো এক অবকাশ যাপনের মতো এক দর্শনীয় স্থান। এরইমধ্যে দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকের ভিড়ে মুখরিত হয়ে উঠেছে। তবে বিষয় ভ্রমণপিয়াসীদের জন্য রজনী অবকাশ যাপনের কোনো ব্যবস্থা নেই।

এই ইউনিয়নে টংক আন্দোলনের আত্মহুতির ইতিহাস বিজড়িত স্থান লেঙ্গুড়া। সুসং মহারাজের শাসনের বিরুদ্ধে তাহারই ভাগিনা কমরেড মনি সিংহের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে এক দূর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন এই পরগনার নিপিড়ীত জনগণ। তারই লেশ ধরে লেঙ্গুড়াতেও টংক আন্দোলনের দানা বেঁধে ওঠে। কমরেড রাশিমনি হাজং এর নেতৃত্বে হাজার হাজার হাজং সম্প্রদায়ের লোকজন লেঙ্গুড়া ই পি আর ক্যাম্প ঘেরাও করলে ইপি আরের গুলিতে শত শত লোক মারা যায়, তাদেরকে পুরাতন ইউনিয়ন পরিষদ ভবন সংলগ্ন গণকবরে সমাহিত করা হয়। টংক আন্দোলনে আত্মহুতি দানকারীদের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করা একান্ত আবশ্যক।

১৯৭১ এর গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের শহিদ বীর সেনানিরা চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এই লেঙ্গুড়ার মাটিতে। ১৯৭১ সালের ২৬ শে জুলাই দিনটি কলমাকান্দাবাসীর জন্য এক হ্নদয় বিদারক দিন। এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে সম্মুখ যুদ্ধে সাত বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন। সীমান্তবর্তী এই জনপদটির উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে চুনামাটি, শ্বেত মৃত্তিকা, সিলেট বালি, নুড়ি পাথর ও কয়লা ইত্যাদি। এখানে উৎপাদিত ফসল সমূহের মধ্যে ধান ও পাট উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া আনারস, কমলা, জুস ও বিভিন্ন প্রকার ফলমূল এখানে পাওয়া যায়। উক্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ও উৎপাদিত ফসল দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজার জাতকরণের জন্য ব্যবসায়ীদের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

লেঙ্গুড়া ইউনিয়নকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছে গণেশ্বরী নদী, তারই তীরে লেঙ্গুড়া বাজার অবস্থিত। গনেশ্বরী নদীতে শীত মৌসুমে বালি দিয়ে অস্থায়ী বাঁধ তৈরি করে এক বিরাট সেচ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়। যাহার উপর নির্ভর করে লেঙ্গুড়া খারনৈ ও নাজিরপুর ইউনিয়নের শত শত একর জমি বোরো চাষের আওতায় আনা হয়। এখানে কোনো প্রকার যান্ত্রিক কৌশল ও জ্বালানি তেলের ব্যবহার ছাড়াই প্রাকৃতিক পানির উপর নির্ভর করে কৃষি নির্ভরশীল এই জনপদের মানুষগুলো হাজার হাজার মে.টন ফসল উৎপাদন করে আসছে, যাতে করে প্রতি বছর সরকারের জ্বালানি তেল ও বিদ্যুৎ সাশ্রয় হচ্ছে। কিন্তু আজও অত্র এলাকার মানুষ সেই অস্থায়ী বালির বাঁধের উপর নির্ভরশীল।

লেঙ্গুড়াতে নানা ধর্ম বর্ণ ও গোত্রের লোকজন বসবাস করে। তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক কোনো মনোভাব নেই। এক সাম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সমাজিক কৃষ্টিকালচার অনুষ্ঠানে অন্য সাম্প্রদায়ের লোকজন আনন্দচিত্তে অংশগ্রহণ করে। এই অসাম্প্রদায়িক মনোভাব চিরস্থায়ী করে ধরে রাখতে লেঙ্গুড়া ই.পি সংলগ্ন সব সাম্প্রদায়ের মানুষের জন্য উন্মুক্ত একটি পাঠাগার একান্ত আবশ্যক। লেঙ্গুড়া বাজারের উত্তরে ফুলবাড়ি গ্রামের বাংলাদেশ সীমান্ত পিলার নং ১১৭২ থেকে মাত্র ৭/৮ কি.মি. উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সর্ববৃহৎ নংগাল কয়লা খনিটি অবস্থিত। নংগাল থেকে উত্তোলিত কয়লা ট্রাকে করে ৪০/৫০ কি.মি. পথ অতিক্রম করে সুনামগঞ্জ জেলার তাহেরপুর উপজেলার বড়ছড়া স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে আমদানি হচ্ছে যাহা পরিবহনে বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় দেশের আমদানি ও রপ্তানিকারকদের অত্যন্ত ব্যয়বহুল, যাহা লেঙ্গুড়া স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠিত হলে প্রতি মে.টন কয়লা পরিবহনের জন্য পরিবহন ব্যয় বাঁচানো সম্ভব হবে। তাছাড়া আমদানীকৃত মালামাল বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করতেও পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাবে। জনশক্তিও সহজে পাওয়া যাবে, সুতরাং সর্বদিক বিবেচনা করলে লেঙ্গুড়া স্থলবন্দরের জন্য একটি সম্ভাবনাময় স্থান হিসাবে পরিগনিত হয়।

তার পাশ্বর্বর্তী পূর্বদিকে ইউনিয়ন খারনৈ ও রংছাতি। এই সীমান্ত রাস্তা হয়ে মহেশখালী মধ্যনগর উপজেলার সুনামগঞ্জ জেলার তাহেপুর নীলাদ্রি লেক শিমুল বাগান। এই রংছাতি ইউনিয়নে একটি প্রাগৈতিহাসিক অবস্থান জড়িয়ে আছে, বর্তমান শতাব্দী হতে প্রায় ১০ হাজার বছর আগে হিমালয় পর্বতের পাশে ভারতের আসাম, মিজুরাম প্রদেশে এক ভয়াবহ ভূ-কম্পনের মাধ্যমে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ঘটে। ফলে হিমালয়ের অনুবৃত্তি পাহাড় পর্বতমালা ও টিলার সৃষ্টি হয়। যাহা শক্ত পাথর ও বেলেমাটি দ্বারা সৃষ্টি। তখন হতে উক্ত স্থানটি এক বড় (ডিঙা) বা নৌকা সদৃশ্য মাস্তুলের আকার দেখা যায়। ইহার অগ্রভাগে এক সুরঙ্গ আছে যেখানে পয়সা বা কোনো ধাতু নিক্ষেপ করলে নয়ন। শব্দ করে কোথায় যেন তলিয়ে যায়।

কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের চন্দ্র তিঙা হরিপুর গ্রাম, বাংলাদেশ বিডিআর ক্যাম্প পাঁচগাও থেকে মাত্র এক কিলোমিটার অদূরে সম্পূর্ণ বাংলাদেশের অভ্যান্তরে অবস্থিত। বর্তমানে প্রস্তাবিত ভারত বাংলাদেশে (মেঘালয়) রামনাথপুর স্কুল বন্দরের পাশে অবস্থিত। জনশ্রুতি আছে হিন্দু ধর্মের দেবী মনসা তার মনসামঙলে চাঁদ সওদাগরের কাহিনী, বঙ্গের এই ভাটির অঞ্চলটি ছিল কালীধর সাগর নামে খ্যাত। চাঁদ সওদাগর মনসা দেবীর সঙ্গে এক বাজী ধরে বাজীতে হেরে তার সপ্ত ডিঙা ভাসিয়ে কালীধর সাগরের দিকে পালিয়ে আসে। কিন্তু দেবীর রাষোনল হতে পালিয়েও শেষ রক্ষা না পেয়ে দিকবিদিক ঘুরতে থাকে। হঠাৎ এক প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পরে এই সপ্তডিঙা ভাসতে ভাসতে কালীধর সাগরের উত্তর প্রান্তে গারো পাহাড়ের এক টিলার সঙ্গে ধাক্কা লেগে সপ্ত ডিঙা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। কালক্রমে নিম্নাঞ্চল ও ভূমি ভরাটের ফলে কালীধর সাগর বিলুপ্ত হয়। পূর্ব বঙ্গের ভাটি অঞ্চলের সমতল অবস্থান নেয়। পাহাড়ের ডালে এখনও ডিঙার মাস্তুল বা শাখা দেখা যায়। পরিশেষে প্রকৃতির সৌন্দর্যের লীলাভূমি সৌন্দর্যের আধার এই মনোরম পাহাড়ি স্থানটি দেশি বিদেশি পর্যটকদের জন্য অতি আকর্ষণীয় স্থান। বিভিন্ন ধর্মের ভক্তরা এসে তাদের মনোবাঞ্চনা পূরণের জন্য ডিঙার গর্তে দুধ ঢালেন, সিন্নী মানসিক করেন। এমনকি প্রতি বৎসর একটি নিদিষ্ট দিনে উৎসবের আয়োজন করা হয়। এতে স্থানীয়ভাবে মেলার আকার ধারণ করে, ঝর্নার সাদৃশ্য কিছু মনোরম পাহাড়ি ছড়া বা নালা দেখা যায়, যেখানে দুরদুরান্ত থেকে আসা পর্যটকেরা নেমে সাঁতার কাটে। এছাড়া অদুরে বহমান বিপুল খরস্রোতা মাহদেও নদী যাহার উৎপত্তিস্থল ভারতের মেঘালয় রাজ্যের দূর্গম পর্তবমালার কোনো গিরি খাদ বা হ্রদ থেকে এই মহাদেও নদীর উৎপত্তি। এ নদী বর্ষাকালে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। হেমন্তের সঙ্গে সঙ্গে প্রলযের বিলুপ্তি ঘটিয়ে দেখা দেয় এক অনাবিল সৌন্দর্যমন্ডিত আকর্ষণীয় পরিবেশ। যতই ঋতুর পরিবর্তন ঘটে তথই তার সুন্দর্য আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। শীতের সঙ্গে সঙ্গে অনাবিল সৌন্দর্যমন্ডীতে প্রশান্তী বিরাজ করে। মনে হয় এক কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতির চাদরে আবৃত স্বচ্ছ বহমান শ্রতরামী। বর্ষায় বিপুল পরিমাণ বালু পাথর ও ভেসে আসা কয়লা উত্তোলন করা হয় প্রকৃতির লীলাভূমি এই অবহেলিত জনপদ থেকে।

আপনিও একবার ঘুরে আসতে পারেন আমাদেরই মেঘালয় সীমান্তবর্তী সবুজের সৌন্দর্যে মন্ডিত ঘেরা নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ও কিংবদন্তি মহুয়া লোক গাথা বিস্তৃত দর্পণ এলাকা থেকে আপনাকে স্বাগত।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত