
চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় অবস্থিত কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড চিনি ও খাদ্য শিল্প ৮৪ বছরেরও বেশি পুরোনো প্রতিষ্ঠান। এটি দেশের একমাত্র লাইসেন্সধারী অ্যালকোহল উৎপাদনকারী। দেশে বিদেশি মদের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় কেরুর মদের চাহিদা বেড়েছে কয়েক গুণ। গত বছর শুল্ক ফাঁকি রোধে মদ আমদানিতে নজরদারি বাড়ায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে বিদেশি মদের সংকট দেখা দেয় দেশের অনুমোদিত বারগুলোতে। তারপর থেকে ক্রমেই বৃদ্ধি পায় দেশে উৎপাদিত মদের চাহিদা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শুধু ডিস্টিলারি বিভিন্ন ইউনিট থেকে মদ বিক্রি করে কেরুর আয় হয়েছে ৪৩৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা। লাভ হয়েছে ১১৫ কোটি টাকারও বেশি, যা কোম্পানির ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিক্রির রেকর্ড।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের মালিকানাধীন ১৫টি চিনিকলের মধ্যে অন্যতম। প্রতিষ্ঠানটি সরকারের জন্যও লাভজনক এবং নিয়মিত করও দেয়। কেরুর প্রাণ মূলত আখ। আখের রসের গুড় থেকে অ্যালকোহল ও বিভিন্ন ধরনের স্পিরিট তৈরি করে থাকে কোম্পানিটি, যা চিনি উৎপাদনের উপজাত। চিনি উৎপাদনের জন্য আখের রস আহরণের পর তিনটি উপজাত পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে গুড়, ব্যাগাস ও প্রেস মাড। মদ বা অ্যালকোহল উৎপাদনের প্রধান উপাদান হলো গুড়। গুড়ের সঙ্গে ইস্ট প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে তৈরি করা হয় অ্যালকোহল। মদের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন বাড়ায় কেরু। বিক্রিও বেড়ে যায়। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে কেরুর মুনাফা।
কেরুতে বর্তমানে ৯টি ভিন্ন ব্র্যান্ডের আওতায় আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য ১০ লাখ ৮০ হাজার প্রুফ লিটার মদ, ২৬ লাখ লিটার দেশি স্পিরিট ও ৮ লাখ লিটার ডিনেচার্ড স্পিরিট উৎপাদন করা হয়। ৯টি মদের ব্র্যান্ড এগুলো হচ্ছে- ইয়েলো লেবেল মল্টেড হুইস্কি, গোল্ড রিবন জিন, ফাইন ব্র্যান্ডি, চেরি ব্র্যান্ডি, ইম্পেরিয়াল হুইস্কি, অরেঞ্জ কুরাকাও, জারিনা ভদকা, রোসা রাম ও ওল্ড রাম। মদের পাশাপাশি ভিনেগার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সার, চিনি এবং গুড় উৎপাদন করে থাকে রাষ্ট্রায়ত্ত এ কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটির ২০০টি বিতরণকারী এজেন্ট এবং সারাদেশে কেরুর ১৩টি ওয়্যারহাউস রয়েছে।
কর্মকর্তা ও স্থানীয় বিভিন্ন আখ চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কেরু অ্যান্ড কোম্পানিতে যোগদানের পর খুব ব্যস্ত সময় পার করছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাব্বিক হাসান। নানা কর্মপরিকল্পনা করছেন, কেরু অনেক পুরোনো একটি প্রতিষ্ঠান। এর ৮৪ বছরের ইতিহাস রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এখানে নানা তাৎপর্যমূলক কাজ হয়েছে। এদেশের মানুষের মনোজগতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি। চেষ্টা করেছে এককভাবে নয়, কেরু গুণগতমান উন্নয়নে সবাইকে নিয়ে কাজ করছেন। এরইমধ্যে কাঁচামাল আখ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কৃষকদের নিয়ে বিভিন্ন স্থানে মাঠ দিবস অব্যাহত রয়েছে।
সুগার মিলটির ডিস্টিলারি বিভাগের উন্নয়ন, কেরুর শ্রমিক সংকট সমাধান, রাসায়নিক ও জৈব কারখানার উন্নয়নসহ বেশ কিছু দৃশ্যমান কাজ করে প্রশংসায় প্রশংসিত কেরু অ্যান্ড কোম্পানির এমডি।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাব্বিক হাসান সম্পর্কে জানা যায়- তিনি একজন চৌকস, সৎ, দায়িত্বশীল ও মানবিক। ৮৪ বছরের এই চিনি কলটিকে আধুনিকীকরণ এবং এর বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি জন্য অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি কৃষকেরা যাতে আখ চাষে বিশেষ গুরুত্ব দেয় তার জন্য নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তিনি। চিনি, ডিস্টিলারি, ফার্মাসিউটিক্যালস, বাণিজ্যিক খামার, আকন্দবাড়িয়া খামার (পরীক্ষামূলক) ও জৈব সার- এই ছয়টি ইউনিট স্যার উন্নয়নমূলক দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন।
নুরুল হাসান নামে এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে যখন দিন দিন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে কমে যাচ্ছে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ। এই বিষয়টি মাথায় রেখে বর্তমানে এমডি স্যার নিজে চাষিদের কাছে গিয়ে স্বল্প জমিতে অধিক আখ উৎপাদনের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদ্ধতিতে আখ চাষ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। চাষিরা ইচ্ছা করলে যে কোনো ধরনের জমিতে আখ চাষ করতে পারবে। বর্তমান এমডি রাব্বিক হাসানের চিন্তাভাবনা কিভাবে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি লাভবান করা যায়। কৃষক কোন পদ্ধতিতে আখ চাষ করলে লাভবান হবে কৃষিকে শিল্পে রূপান্তরিত করতে পারলে কমে যাবে দেশের বেকার সমস্যা। তাই উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তালমিলিয়ে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করা খুব জরুরি। বৃত্তাকার গর্তে আখ রোপণ করা হচ্ছে এখন। আখের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য এরইমধ্যে তিনি বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন। যাতে করে চাষিরা আখ চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এলাকাবাসীর নিকট আমার উদাত্ত আহ্বান আপনাদের এ প্রতিষ্ঠান বাঁচিয়ে রাখতে অন্তত কম বেশি আখ চাষ করেন। কারণ আখের মূল্য নির্ধারিত এবং বিক্রির গ্যারান্টি আছে বলে মন্তব্য করেন এই কর্মকর্তা।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাব্বিক হাসান জানান, শিল্প উপদেষ্টা, শিল্প সচিব ও বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানের সার্বিক দিকনির্দেশনায় মোতাবেক, দেশের ঐতিহ্যবাহী চিনি শিল্প এই কেরু অ্যান্ড কোম্পানি অন্যান্য পণ্যে উৎপাদনসহ এই চিনি শিল্পকে এগিয়ে নিতে এবং সর্বোচ্চ লাভজনক হিসাবে পরিণত করতে আমরা নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছি। যা এরইমধ্যে বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে। যার মধ্যে আখের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে, ভালো মানের বীজ নির্ধারণসহ কৃষি কাজে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যান্য বারের তুলনায় এবার চিনিকলের লোকসানের অংক কমে আসবে এবং আগামীতে তা লাভজনক হিসাবে রূপান্তরিত হবে বলে আমি আশাবাদী। তবে চিনিশিল্পের প্রধান কাঁচামাল আখ। চিনিশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে আখ চাষের কোনো বিকল্প নেই।
আমরা বাইরের দেশ থেকে চিনি আমদানি নির্ভরতা কমাতে চাই, সংকট কাটিয়ে উঠতে চাই এবং সিন্ডিকেট ভাঙতে চাই। চিনি উৎপাদন বাড়াতে কাঁচামাল পণ্য হিসেবে আখ প্রয়োজন। আখের উৎপাদন বাড়াতেও সরকার উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ সরবরাহ করছে, ঋণ দিচ্ছে এবং গত দুই বছর থেকে আখের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। চাষিদের উৎসাহিত করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। রাব্বিক হাসান আরও বলেন, কঠোর পরিশ্রম ছাড়া জীবনে সাফল্য অর্জন করা কঠিন। একটি সমাজ বা জাতির উন্নতির জন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রমী নাগরিক। যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী, সে জাতি তত বেশি উন্নত। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো তাদের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই উন্নতির শিখরে উঠেছে।
মানুষ যদি তার লক্ষ্যে অটুট থাকে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে, তবে একদিন সে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছতে পারে বলে আমি মনে করি, কেরু অ্যান্ড কোম্পানির বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের হাত ধরে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের সর্বোচ্চ লাভের দিকে অগ্রসর হবে ইনশাল্লাহ।