ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

চান্দিনায় খাল দখল-ভরাটে কৃষি ও পরিবেশ হুমকির মুখে

চান্দিনায় খাল দখল-ভরাটে কৃষি ও পরিবেশ হুমকির মুখে

কুমিল্লার চান্দিনা এক সময় খালবেষ্টিত জনপদ হিসেবে পরিচিত ছিল। গ্রামীণ জীবনযাত্রা, কৃষিকাজ, এমনকি পরিবহন ব্যবস্থাতেও খালগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বর্ষার পানি সহজেই খালের মাধ্যমে নিষ্কাশন হতো, কৃষকের জমি সেচের পানির যোগান পেত, আর মাছ চাষেও খালের ওপর নির্ভরশীল ছিল সাধারণ মানুষ। কিন্তু আজ সেই খালগুলো দ্রুত ভরাট হয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রভাবশালী মহল দখল করে সেখানে গড়ে তুলছে বসতবাড়ি, দোকানপাট, বাজার কিংবা বিভিন্ন অবকাঠামো। পাশাপাশি ময়লা-আবর্জনা ও বর্জ্য ফেলার কারণে খালগুলো ক্রমেই অচল হয়ে পড়ছে। এর ফলে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি জমি, নষ্ট হচ্ছে মাছের প্রাকৃতিক আবাসস্থল এবং বাড়ছে পরিবেশের অসামঞ্জস্য।

চান্দিনার খালগুলোর ভরাট হয়ে যাওয়া শুধু কৃষক ও সাধারণ মানুষের জন্য নয়, পুরো এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্যও এক বড় হুমকি। বর্ষা মৌসুমে অল্প বৃষ্টিতেই পানি জমে থাকে দীর্ঘদিন, যা মানুষের ভোগান্তি বাড়িয়ে তোলে। অথচ একসময় এই খালগুলোই ছিল গ্রামের প্রাণশক্তি, যা প্রকৃতিকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখতো। খাল দখল ও ভরাট বন্ধ করে এগুলো সংরক্ষণ না করলে আগামী দিনে চান্দিনার জলাবদ্ধতা সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে এবং কৃষি উৎপাদনেও বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তাই এখনই খাল রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া সময়ের দাবি।

চান্দিনা বাজারের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ক্ষীরদ খাল।

চান্দিনা পৌরসভার আরেকটি খাল হচ্ছে চান্দিনা-ছায়কোট খাল। এ খালটি আবর্জনায় ভরা। পৌরসভার বাইরের খালগুলোর অবস্থা আরও ভয়ানক। মাধাইয়া পশ্চিম বাজার সংলগ্ন খালও আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে। পলিথিন আর ময়লা আবর্জনার কারণে খালগুলো চেনাই যায় না।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, উপজেলা পরিষদের উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ময়লা-আবর্জনায় ভরা। যার কারণে সামান্য বৃষ্টিতে বাজারের অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিপূর্ণ থাকায় পানি সরতে পারছে না। খাল উদ্ধার ও পরিষ্কার রাখতে সাবেক পৌর মেয়র ও বর্তমান পৌর প্রশাসকের কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

ওই খাল দখল করে মার্কেট ও হোটেল নির্মাণ হয়েছে। পানি প্রবাহের কোনো পথ নেই। যার কারণে পাশেই অবস্থিত আল-আমিন ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে। একটু বৃষ্টি হলেই মাদ্রাসা মাঠ পানিতে ডুবে যায়। খাল দখল ও ভরাটের কারণে পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে গেছে।

স্থানীয়রা জানান, খালটির দেড় কিলোমিটার অংশ পৌরসভা, জেলা পরিষদ, সওজ ও পার্শ্ববর্তী দেবিদ্বার উপজেলাভুক্ত। এই জটিল সমীকরণে কোনো পক্ষ এগিয়ে আসছে না। খালটি দখল, দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এ খালই এখন চান্দিনা পৌরসভার বাসিন্দাদের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি এ শহরের বিশাল জনগোষ্ঠীর আবর্জনার ভার বয়ে বেড়ানো অনেক খাল ধুঁকে ধুঁকে অনেকটাই নিঃশেষ হয়ে গেছে। আর এ নিষ্ঠুর পরিণতি পোহাতে হচ্ছে শহরের সাধারণ বাসিন্দাদের।

চান্দিনা পৌরসভার আরেকটি খাল হচ্ছে চান্দিনা-ছায়কোট খাল। এ খালটিও আবর্জনায় ভরা। যার কারণে সামান্য বৃষ্টিতেও পানি সরে না। একটু বৃষ্টিতেই আশপাশের এলাকায় সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। পলিথিন, খাবারের প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতল আর ফলের পরিত্যক্ত ঝুড়িতে ভরপুর এই খাল। সঙ্গে গৃহস্থালি বর্জ্যরে স্তূপ। দূর থেকে দেখলে একে খাল ভাবা মুশকিল। ফলে পানি নিষ্কাশনের এ খালটি অনেকের কাছে মশা উৎপাদনের ‘কারখানা’ হিসেবে পরিচিত। মশার উৎপাতে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল কাদের জানান, এ খাল দিয়ে একসময় এলাকার বৃষ্টির পানি নামত। কিন্তু তা এখন ময়লার ভাগাড়। তবে সম্প্রতি এ খালটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পৌর কর্তৃপক্ষ বলছে, এটির সংস্কার শেষ হলে এ এলাকায় জলাবদ্ধতা থাকবে না।

কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (অ. দা.) মো. আশ্রাফুজ্জামান খান ও প্রকৌশলী মাহিউদ্দিন জানান, চান্দিনায় পানি উন্নয়ন বোর্ড তালিকাভুক্ত কোনো খাল নেই। ম্যাপ দেখে দখলকৃত খালগুলো উদ্ধার ও ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হওয়া খালগুলো খননে কাজ করব।

জেলা পরিষদের উচ্চমান সহকারী ( সাধারণ শাখা) কিশোর কুমার দেবরায় জানান, আমরা ৩০ বছরের জন্য খাল বাদ দিয়ে পাড় লিজ দিয়েছি। কেউ যদি খাল ভরাট করে দখল করে থাকে, সেটা ঠিক করেনি।

চান্দিনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পৌর প্রশাসক মোহাম্মদ আশরাফুল হক জানান, চান্দিনা বাজারের পশ্চিম পাশের খালটি পুরোটা আমাদের নয়। কয়েকটি পক্ষ (পৌরসভা, জেলা পরিষদ, সওজ, দেবিদ্বার অংশ) জড়িত। সবাইকে বলেছি। এখন একটি সমন্বিত মিটিং হতে হবে। যার যতটুকু অংশ আছে খনন করে দেবে।

চান্দিনার খালগুলো দখল ও ভরাট হয়ে হারিয়ে যাওয়া শুধু একটি এলাকার সমস্যা নয়, বরং পুরো পরিবেশ ও কৃষির জন্য বড় হুমকি। সময় থাকতে যদি খালগুলো সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে জলাবদ্ধতা ও পরিবেশ বিপর্যয় আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। তাই খাল রক্ষা করা এখনই জরুরি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত