
কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার মাইজখার ইউনিয়নের ভোমারকান্দি গ্রামের যুবক কামরুল হাসান খান সেলিম। আজ সফল ড্রাগন ফল চাষি হিসেবে পরিচিত। নিজের পরিশ্রম, ধৈর্য আর সাহসিকতায় তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, গ্রামেই থেকেও সাফল্য অর্জন সম্ভব। চান্দিনা উপজেলা কৃষি অফিসের তত্ত্বাবধানে আধুনিক কৃষিতে নতুন দিগন্ত খুলে তিনি এখন এলাকার মানুষের কাছে প্রেরণার প্রতীক। সাত বছর আগের কথা।
সরকারি চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত হয়ে কামরুল হাসান খান সেলিম ২ একর জায়গাতে ৪ হাজার ড্রাগনের চারা রোপণ করেন। তখন এলাকার মানুষের মধ্যে ড্রাগন ফল সম্পর্কের তেমন কোনো ধারণা ছিল না। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এখন ড্রাগন ফল সম্পর্কে ধারণা পেয়েছে। এখন মানুষ বাজার থেকে কিনে ড্রাগন ফল খাচ্ছে। সেলিমের বাগানেও যথেষ্ট পরিমাণ ফলন হয়েছে। প্রথম শুরুতেই তিনি ৩৯ লক্ষ টাকা ব্যয় করে ড্রাগনের চাষ শুরু করেছিলেন। শুরুর দিকে অনেকেই তাকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। কেউ বলেছিলেন, ড্রাগন ফল বাংলাদেশের আবহাওয়ায় টিকবে না। কিন্তু তিনি আত্মবিশ্বাস হারাননি। স্থানীয় কৃষি অফিসের পরামর্শ নিয়ে শুরু করেন নিয়মিত পরিচর্যা। দুই বছর পর গাছে আসে প্রথম ফল। সেলিম বলেন, যখন প্রথম গাছে ফুল ও ফল দেখতে পেলাম, তখন মনে হয়েছিল আমার স্বপ্ন সত্যি হচ্ছে।
সেলিম খান জানান, সাত বছর আগ থেকে আমি ড্রাগন চাষ করে এ পর্যন্ত আমি ৪৫ লাখ টাকার ড্রাগন বিক্রি করেছি। আমার বাগানে যখন প্রথম ড্রাগন ফল আসে তখন আমি ৭০০ টাকা কেজি ও বিক্রি করেছি, বর্তমানে বাজার আগের চেয়ে কিছুটা কম, তারপরও আমার লস নেই। সেলিম জানান, আমার বাগানের ড্রাগন জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এসে কিনে নেয় এবং নিমসার পাইকারি বাজার ও ঢাকাতেও আমার ড্রাগন বিক্রি করা হয়। সেখান থেকেই তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। পরের বছর তিনি বাগান সম্প্রসারণ করেন। এখানে লাল জাতের ড্রাগনের চাষ হচ্ছে। গাছগুলো সারি সারি করে সাজানো, বাঁশ ও কংক্রিটের খুঁটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে শক্ত কাঠামো। প্রতিটি গাছে নিয়মিত জৈব সার, হরমোন ও সেচের ব্যবস্থা রয়েছে।
সেলিম খান জানান, প্রতিবছর এপ্রিল মাস থেকে নভেম্বর মাসের ১৫ দিন পর্যন্ত ড্রাগন ফলের ফুল ফল আসে তারপরে আর আসে না। এই সময়ের মধ্যে আমার বাগান থেকে ড্রাগন বিক্রি করে আমার প্রতি বছর লাভ হয় ১৫ লক্ষ টাকা। তিনি জানান, আগামী আরও কয়েক বছর পর্যন্ত আমারে বাগান অনবরত ফল আসবে। এজন্য আমার আর কোন বাড়তি খরচ করতে হবে না, শুধু স্যার ও পানি দিয়ে দিলেই হবে। সেলিম খান আরও জানান, আমার দেখাদেখি অনেকেই আমার থেকে চারা নিয়ে নবাবপুর ও রানিচড়াতে ড্রাগনের চাষ করেছে। তাদের বাগানের অবস্থান ও ভালো বলে জানান তিনি। তিনি শিক্ষিত বেকার উদ্দেশ্যে বলেন, চাকরির পিছনে না ঘুরে লাভজনক ড্রাগনের চাষ করা যায়। তার এলাকার অনেক লোক এখন তার ড্রাগনের চাষ দেখে ড্রাগন চাষ করার জন্য উদ্যোগী হয়েছেন। তিনি জানান, আমার ড্রাগনে কোন রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা হয়নি কোন ফরমালিন ও ব্যবহার করা হয়নি। আমার ড্রাগন প্রাকৃতিকভাবে হচ্ছে যা খেলে মানুষের উপকার হবে কোন ক্ষতি হবে না।
চান্দিনা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোরশেদ আলম বলেন, সেলিম আমাদের উপজেলায় ড্রাগন চাষের অগ্রদূত। তার সফলতা দেখে আরও অনেক কৃষক আগ্রহী হয়েছেন। আমাদের কৃষি অফিস থেকে তাকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের চান্দিনা কৃষি অফিসের তত্ত্বাবধানে মোট সাড়ে পাঁচ একর জমিতে ড্রাগনের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। যারা নতুন নতুন ড্রাগনের চাষ করতে চান আমরা তাদেরকে বিভিন্নভাবে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে থাকি এবং সার্বক্ষণিক আমরা নতুন ড্রাগন চাষিদের সেবা দিয়ে থাকি। সেলিম জানান, ড্রাগন চাষ সহজ মনে হলেও নিয়মিত যত্ন না নিলে ফলন কমে যায়। গাছে ছত্রাক ও পোকা আক্রমণ করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হয়। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ধৈর্য। গাছ লাগানোর দুই বছর পর ফল পাওয়া যায়, তাই মনোবল রাখতে হয়।
এখন তার বাগানে কয়েকজন স্থানীয় তরুণ কাজ করছেন। সেলিম তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলছেন। কেউ কেউ তার কাছ থেকে চারা সংগ্রহ করে নিজেরাও ড্রাগন চাষ শুরু করেছেন। এতে এলাকার বেকার যুবকদের মধ্যে নতুন উদ্যম সৃষ্টি হয়েছে। ড্রাগন ফল বর্তমানে দেশে জনপ্রিয় একটি ফল।
এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’, ক্যালসিয়াম, আয়রন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। এটি ত্বক, হজম ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কার্যকর। ফলে বাজারে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। কামরুল হাসান খান সেলিম বলেন, ‘ড্রাগন চাষ শুধু লাভজনক নয়, এটি পরিবেশবান্ধবও। একবার গাছ লাগালে ১৫-২০ বছর পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়, এবং যত বছর যায় গাছ তত ফলন দেয়। তার বাগান এখন চান্দিনা উপজেলার কৃষি পর্যটনের এক আকর্ষণ। আশপাশের এলাকা থেকে অনেকেই বাগান দেখতে আসেন, ছবি তোলেন, পরামর্শ নেন। সেলিম সবাইকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানান এবং ড্রাগন চাষের খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দেন।
তিনি এখন নিজ গ্রামেই আত্মনির্ভর একজন উদ্যোক্তা। তার মুখে এখন আত্মবিশ্বাসী হাসি। তিনি বলেন, আমি প্রমাণ করেছি, পরিশ্রম করলে মাটিতেই স্বপ্ন ফোটে। চান্দিনার এই সফল কৃষক দেখিয়ে দিয়েছেন, গ্রামীণ মাটিতে আধুনিক কৃষির সুযোগ কাজে লাগালে ভাগ্য বদলানো সম্ভব। কামরুল হাসান খান সেলিম এখন শুধুই একজন ড্রাগন চাষি নন, তিনি এক অনুপ্রেরণার প্রতীক, যিনি শিখিয়েছেন, সাফল্যের বীজ বপন হয় নিজের মাটিতেই।