
চুয়াডাঙ্গা জেলার মাঠে এখন আগাম শীতকালীন সবজির সবুজ ছড়াছড়ি। মাঠে মাঠে সজীব বেগুন, ফুলকপি, টমেটো, শিম আর করলার সমারোহ। তবে কৃষকদের মুখে নেই হাসি, বাজারে তাদের ঘামের ন্যায্য মূল্য মিলছে না। কৃষকের কাছ থেকে ৪০-৫০ টাকায় কেনা বেগুন খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। শিম, করলা, ঢেঁড়স, টমেটো সবজির দাম উঠেছে আকাশছোঁয়া। হাতে গোনা কয়েকটি সবজি ছাড়া বাকি সব কেজিপ্রতি শত টাকার ঘরে। একদিকে অল্প দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা, অন্যদিকে ভোক্তারা হিমশিম খাচ্ছেন চড়া দামে কিনতে গিয়ে। ঘন ঘন হাতবদল, পাইকারদের সিন্ডিকেট ও বাজার তদারকির দুর্বলতায় দামের এই অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শংকরচন্দ্রপুর গ্রামের কৃষক দোয়াল্লিন ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, এক বিঘা জমিতে সবজি উৎপাদন করতে খরচ পড়ে ২৫-৩০ হাজার টাকা। সার, শ্রমিক, বীজ, ওষুধ সবকিছুর দামই এখন আকাশছোঁয়া। কিন্তু বাজারে গিয়ে দেখি, দামের নামে তামাশা! পাইকাররা এক রকম জোর করেই কম দামে কিনে নেয়। এরপর কয়েক হাত ঘুরে খুচরা বাজারে দাম হয় চারগুণ। আমরা কৃষকরা পণ্যের ন্যায্য দাম পাই না। সরকারও আমাদের খবর রাখে না, কৃষি অফিস থেকেও কেউ আসে না। এত খরচ করে যদি দামই না পাই, সংসার চলবে কেমন করে? তার মতো অনেক কৃষকের অভিযোগ, মধ্যস্বত্বভোগীরা প্রতি কেজি সবজিতে ১৫-২০ টাকা পর্যন্ত লাভ করে। বড় আকারের সবজি যেমন লাউ এতে লাভ হয় ১৫-২৫ টাকা পর্যন্ত। খুচরা বাজারে জায়গাভেদে এই লাভের অঙ্ক আরও বেড়ে যায় দ্বিগুণ বা তারও বেশি।
চুয়াডাঙ্গা শহরের নিচের বাজারের সবজি বিক্রেতা হাবিবুর রহমান বলেন, কৃষকরা প্রথমে তাদের এলাকার স্থানীয় হাটে সবজি নিয়ে আসে। সেখানে ফড়িয়া বা পাইকারদের একটা সিন্ডিকেট থাকে। তারা মিলে একটা দাম নির্ধারণ করে দেয়। সেই দামে তারা মণ হিসেবে কিনে নেয়। পরে দুই-তিন হাত ঘুরে যখন খুচরা বিক্রেতার কাছে আসে, তখনই মূল দামের পার্থক্য হয় তিন-চার গুণ। আমরা ছোট বিক্রেতারা সেই দামে না নিলে বাজারে টিকতে পারি না।
অন্যদিকে সবজি আড়তদার ব্যবসায়ী মাজিদ হোসেন কিট বলেন, এ বছর টানা বৃষ্টি আর গরমে সবজির বাজারে ওঠাণ্ডনামা হচ্ছে। এখন সরবরাহ কম, দাম তাই একটু বেশি। কয়েক দিন পর থেকে বাজারে আমদানি বাড়বে, তখন দামও কমে আসবে। কৃষকদেরও লাভ হবে।
গতকাল রোববার চুয়াডাঙ্গার নিচের বাজারসহ অন্যান্য বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সবজির সরবরাহ মোটামুটি পর্যাপ্ত। তবুও দাম যেন কমার নামই নিচ্ছে না। বাজারে বেগুন কেজি ১০০ টাকা, করলা কেজি ১০০ টাকা, ঢেঁড়স কেজি ৮০-১০০ টাকা, পটল কেজি ৬০ টাকা, টমেটো কেজি ১৬০ টাকা, কাঁচামরিচ কেজি ২০০ টাকা, পেঁয়াজ কেজি ৯০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া কেজি ৫৫-৬০ টাকা। এছাড়া ফুলকপি ও বাঁধাকপি এখনও আগাম মৌসুমের বলে প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে ৮০-৯০ টাকায়। আদা ও রসুনের দাম কিছুটা কম থাকলেও সামগ্রিকভাবে বাজারে ‘আগুন’ অবস্থা।
বাজারে সবজি কিনতে আসা শহরের দৌলতদিয়া মোড়ের বাসিন্দা সুমন হোসেন বলেন, বাজারে ঢুকলেই এখন ভয় লাগে। সবজির দামে আগুন লেগেছে। আগে যে সবজি ৭০-৮০ টাকায় কিনতাম, এখন দিতে হচ্ছে ১২০ টাকা। এক কেজি বেগুন কিনতে গিয়ে ভাবতে হয়, বাড়িতে কয়জন খাবে! এভাবে চললে সাধারণ মানুষের পক্ষে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়বে।
আরেক ক্রেতা শারমিন আক্তার বলেন- আগে ৫০০ টাকায় সপ্তাহের বাজার হয়ে যেত, এখন ৫০০ টাকায় একদিনেরও বাজার হয় না। সবজির দামে স্থিতিশীলতা না ফিরলে সবাই বিপদে পড়বে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাসুদুর রহমান সরকার বলেন, প্রান্তিক কৃষকরা প্রায়ই বঞ্চিত হন। তারা উৎপাদন করেন, কিন্তু বাজার ব্যবস্থায় তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কৃষি অধিদপ্তর এরইমধ্যে উৎপাদন ও প্রশিক্ষণমূলক কাজের জন্য ‘কৃষক গ্রুপ’ গঠন করেছে। এখন দরকার কৃষি বিপণনকেও একইভাবে সংগঠিত করা। অনলাইন ও অফলাইন দুটো প্ল্যাটফর্মেই কৃষি বিপণনকে শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি বাজার তদারকি ও মনিটরিং বাড়াতে হবে। তাহলেই কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাবে, ভোক্তারাও স্বস্তি ফিরে পাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্রেতা জানান, আমাদের কৃষি বাজারব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নেই। উৎপাদন পর্যায় থেকে খুচরা পর্যায় পর্যন্ত অন্তত চার-পাঁচ স্তরে হাতবদল হয়। এই প্রতিটি স্তরে কিছুটা করে লাভ যোগ হয়, যা শেষে ভোক্তার ওপর চাপ পড়ে। স্থানীয় প্রশাসন ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।
চুয়াডাঙ্গার উর্বর মাটিতে ফলছে নানা জাতের সবজি, কিন্তু সেই সবজির ন্যায্য দাম কৃষকের হাতে পৌঁছায় না। মাঠে ঘাম ঝরিয়ে ফসল ফলানো কৃষক হারাচ্ছেন স্বপ্ন, আর বাজারে ভোক্তা হারাচ্ছেন ক্রয়ক্ষমতা। দুজনের মাঝখানে লাভের হাসি শুধু মধ্যস্বত্বভোগীদের মুখে। কৃষকদের আশা একদিন হয়তো এমন দিন আসবে, যখন তাদের ঘামের দাম ঠিকঠাক পৌঁছে যাবে নিজেদের হাতে, আর বাজারে ভোক্তার ঝুড়িও ভরবে স্বস্তিতে।