
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের সেই রাতটি যেন এখনও অমলিন। ঘূর্ণিঝড় সিডর এর ভয়াল তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়েছিল উপকূলের বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা। আকাশে বজ্রপাত, প্রবল জলোচ্ছ্বাস আর মৃত্যুর গন্ধে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল গোটা উপকূল। সরকারি হিসাব অনুযায়ী সিডরে ঘর এবং গাছে চাঁপা পড়ে ও পানিতে ডুবে নিহত হয়েছিলেন ৩৪৯ জন, নিখোঁজ হয়েছিলেন ৪৯ জন। বেসরকারি হিসেবে মৃত্যু এবং নিঁখোজ এর সংখ্য ছিল প্রায় দেড় হাজার। সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত বিশখালী এবং বলেশ্বর নদীর দুই তীরের ১১৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ পানি উন্নয়ন বোর্ড জোড়া তালি দিয়ে কিছুটা টিকিয়ে রাখলেও দীর্ঘ ১৮ বছরেও টেকসই বেড়িবাঁধ না হওয়ায় হতাশ উপজেলার মানুষ। সিডরের পর থেকেই তাদের দাবি ছিল ত্রাণের দরকার নেই টিকসই বেড়িবাঁধ চাই। উপকূলের লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষের চাওয়া কবে পূরণ হবে তা কেউ বলতে পারে না বলে জানান পাথরঘাটা উপজেলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কবির।
পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের মাছ ব্যবসায়ী ইউনুস মিয়া (৬৫) সিডরের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আকাশটা লাল হয়ে গিয়েছিল, গর্জে উঠেছিল সমুদ্র। মনে হয়েছিল, আজ আর কেউ বাঁচব না, সিডরের পরের দিন মৃত্যু ও নিঃশব্দতার রাজ্যে পরিণত হয়েছিল গোটা উপকূল। ট্রলারেরর মাঝি নাসির উদ্দিন জানান, সিডরের পরদিন ভোরে সূর্য উঠলেও চারপাশে শুধু ধ্বংসস্তূপ। লাশের সারি, ভেসে আসা নৌকা, উল্টে থাকা ঘরবাড়ি যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র।
বেঁচে থাকা মানুষগুলো খুঁজে বেড়িয়েছেন আপনজনকে, কেউ কাঁদছেন হারানো সন্তান বা স্বামী-স্ত্রীর জন্য। সিডর আমাদের ঘর, ফসল, সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। তখন থেকে আজও ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন বলে জানান, স্থানীয় কৃষক হাবিবুল ইসলাম। তিনি আরও জানান অর্থনৈতিক টানাপোড়ন আজও কাটেনি। সিডরের পর লবণাক্ত পানিতে নষ্ট হয়ে যায় ফসলের জমি। নারকেল, সুপারি ও পানের বরজ ধ্বংস হয়ে যায়, নৌকাণ্ডজাল হারিয়ে বিপাকে পড়েন মৎস্যজীবীরা। ১৮ বছর পার হলেও অনেকে এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন। আমরা সিডরের ক্ষতি এখনও পুরোপুরি সামলাতে পারিনি। একবার জোয়ার এলেই এখনো আতঙ্কে থাকি,” বলেন স্থানীয় নারী সাহেরা বেগম। উপকূলের গরীব মানুষের বেড়িবাঁধ ই একমাত্র আশ্রয়স্থল। সিডরের পর থেকেই পাথরঘাটার মানুষের মুখে একটাই দাবি টেকসই বেড়িবাঁধ। প্রতিবছর যেটুকু মেরামত করে অল্প স¦ল্প ঝড়েই তা আবার নিঃস্ব হয়ে যায়।
স্থানীয় স্কুলশিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, প্রতিবছর বর্ষাকালে ও উচ্চ জোয়ারে নদীভাঙনে ডুবে যায় বাড়িঘর। বাঁধ ভেঙে গেলে আবারও ফিরে আসে সিডরের আতঙ্ক। তিনি আরও বলেন প্রতিবারই আমরা নতুন করে ঘর তুলি, আবার ভেসে যায়। যদি একটা শক্ত বেড়িবাঁধ হতো, তাহলে অন্তত মনে শান্তি পেতাম। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাথরঘাটার কর্মকর্তা মামুন মিয়া জানান, বেড়িবাঁধ আংশিক সংস্কার করা হলেও স্থায়ী ও টেকসই বাঁধ নির্মাণে পর্যাপ্ত বাজেটের অভাব রয়েছে।