
চান্দিনার উর্বর পলিমাটিতে এখন সবুজের সমারোহ, আর সেই সবুজের বুক চিরে উঁকি দিচ্ছে ধবধবে সাদা ফুলকপি। কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলা বরাবরই সবজি চাষের জন্য বিখ্যাত, তবে এবারের শীতকালীন মৌসুমে ফুলকপির বাম্পার ফলন স্থানীয় কৃষি অর্থনীতিতে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে। বিস্তীর্ণ মাঠের দিকে তাকালে দেখা যায় কৃষকদের ব্যস্ততা; কেউ জমি থেকে কপি সংগ্রহ করছেন, কেউবা তা পরম যত্নে বাজারে পাঠানোর জন্য বস্তাবন্দি করছেন।
চলতি মৌসুমে উপজেলায় মোট ১৪৯৫ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজির চাষ হয়েছে, যার সিংহভাগ জুড়েই রয়েছে ফুলকপি। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ কেবল চাষাবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি পাল্টে দিচ্ছে এলাকার হাজারো কৃষকের জীবনযাত্রার মান ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট। উপজেলার মেহার গ্রামটি এখন ফুলকপি চাষের অন্যতম প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এই গ্রামেরই একজন আদর্শ কৃষক আব্দুল মতিন, যার চোখেমুখে এখন তৃপ্তির হাসি। তিনি এ বছর ৩০ শতক জমিতে ফুলকপির আবাদ করেছেন। মতিন জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং সঠিক সময়ে চারা রোপণ ও পরিচর্যা করার ফলে এবার ফলন হয়েছে আশাতীত। মাঠের প্রতিটি কপি আকারে বেশ বড় এবং গুণগত মানে চমৎকার হয়েছে। বাজারেও এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে পাইকারি ও খুচরা বাজারে প্রতিটি ফুলকপি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মতিনের মতে, চাষাবাদের শুরুতে সার, বীজ এবং শ্রমিকের পেছনে যে পরিমাণ পুঁজি তিনি বিনিয়োগ করেছিলেন, বর্তমান বাজারমূল্য বজায় থাকলে মৌসুম শেষে বিনিয়োগের দ্বিগুণ লাভ ঘরে তোলা সম্ভব হবে।
চান্দিনার এই সমৃদ্ধির পেছনে কাজ করছে এখানকার কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ছোঁয়া। কৃষকরা এখন শুধু প্রথাগত পদ্ধতিতে সীমাবদ্ধ নেই, তারা কৃষি অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক পরিমাণে সুষম সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করছেন। ফলে রোগবালাইয়ের প্রকোপ অনেক কমেছে এবং কপির শুভ্রতা ও সতেজতা দীর্ঘক্ষণ বজায় থাকছে। মেহার গ্রাম ছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এবার ফুলকপির ব্যাপক চাষ হয়েছে। ভোরের আলো ফোটার আগেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশের বাজারগুলোতে জমে ওঠে ফুলকপির বিশাল হাট। ট্রাকের পর ট্রাক বোঝাই হয়ে এই কপি চলে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে চান্দিনার ফুলকপি এখন জাতীয় পর্যায়ে সবজির জোগান দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তবে এই সাফল্যের পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে। কৃষকদের দাবি, যদি স্থানীয় পর্যায়ে সবজি সংরক্ষণের জন্য হিমাগার বা আধুনিক কোল্ড স্টোরেজ থাকত, তবে তারা বাজারের অস্থিরতার সময় কপি মজুত করে আরও বেশি লাভবান হতে পারতেন।
অনেক সময় একসঙ্গে প্রচুর সরবরাহ বেড়ে গেলে দাম কিছুটা কমে যায়, যা ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তা সত্ত্বেও, এ বছর পোকাণ্ডমাকড়ের আক্রমণ কম হওয়া এবং বাজারদর স্থিতিশীল থাকায় লাভের পাল্লা কৃষকদের দিকেই ভারী হয়ে আছে। আব্দুল মতিনের মতো শত শত কৃষক এখন স্বপ্ন দেখছেন এই লাভের টাকায় পরিবারের সচ্ছলতা ফেরানোর, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ জোগানোর এবং আগামী মৌসুমে আরও বড় পরিসরে চাষাবাদ করার।
সব মিলিয়ে চান্দিনার কৃষি চিত্র এখন এক উজ্জ্বল সম্ভাবনার দিকে এগোচ্ছে। ১৪৯৫ হেক্টর জমির এই বিশাল সবুজ বিপ্লব প্রমাণ করে যে, সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং কৃষকদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে কৃষিই হতে পারে গ্রামীণ অর্থনীতি পরিবর্তনের প্রধান হাতিয়ার।
মেহার গ্রামের ফসলের মাঠ থেকে শুরু করে চান্দিনার পাইকারি বাজার পর্যন্ত সর্বত্রই এখন বইছে খুশির জোয়ার। ফুলকপির এই বাম্পার ফলন শুধু কৃষকের মুখে হাসি ফোটায়নি, বরং এটি দেশের সামগ্রিক খাদ্যনিরাপত্তা এবং পুষ্টির চাহিদাও পূরণ করছে। আব্দুল মতিনের সেই ৩০ শতক জমির সফল গল্প এখন চান্দিনার প্রতিটি কৃষকের ঘরে ঘরে অনুপ্রেরণা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।