আসন্ন ঈদুল ফিতর সামনে রেখে ঢাকার বিভিন্ন শপিংমল ও আবাসিক এলাকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বেসরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ গঠন করতে যাচ্ছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। পুলিশের জনবল স্বল্পতার কারণে এই অক্সিলিয়ারি ফোর্স গঠিত হচ্ছে। ঢাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিতে ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ পুলিশের মতোই অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে পারবে। নতুন এই ফোর্সে ৫০০ জন জনবল নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করেন ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী।
গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকারের সামনে যেসব বিষয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসে তার মধ্যে অন্যতম আইনশৃঙ্খলা রক্ষা। কিন্তু পুলিশের স্বল্পতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে। সেজন্য ঈদকে সামনে রেখে বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীদের নিয়ে নতুন একটি ফোর্স গঠিত হবে। ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ গঠনের বিষয়ে গতকাল শনিবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ঈদে যেহেতু রাত পর্যন্ত শপিং সেন্টারগুলো খোলা থাকবে এবং আমাদের পুলিশের স্বল্পতা রয়েছে। সেহেতু মেট্রোপলিটন পুলিশের আইনবলে অক্সিলিয়ারি পুলিশ ফোর্স নিয়োগ দেয়া হবে। ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ নিয়োগের ক্ষমতা আমার আছে। আমি সেই মোতাবেক অক্সিলিয়ারি পুলিশ ফোর্স হিসেবে যারা প্রাইভেট নিরাপত্তার লোকেরা আছেন, তাদের নিয়োগ দেব।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি কিংবা খুনের জন্য সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দেয় ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকা। অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশ ও র্যাব কয়েকবার অভিযান চালালেও ছিনতাইয়ের ঘটনা কমাতে পারেনি। বরংচো গত বছরের সেপ্টম্বর ও অক্টোবরে গুলি, ধারালো অস্ত্রের কোপ আর পিটুনিতে মোহাম্মদপুর এলাকায় প্রায় ১০ জনের প্রাণহানির পাশাপাশি অর্ধশতাধিক আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। চুরি-ছিনতাই, কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য কিংবা আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাজধানীজুড়ে এমন ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। শেষমেষ মোহাম্মদপুরে যৌথবাহিনী অভিযান চালায়, সেই অভিযানে বেশকিছু অপরাধী গ্রেপ্তার করা হয়। শুধু মোহাম্মদপুরে নয়, রাজধানীতে ছিনতাইয়ের খবর প্রায়ই শোনা যায়। ছিনতাইকারীর ছুরিতে কারও কারও প্রাণ যাচ্ছে।
তবে ঈদকে সামনে রেখে বাড়তি নিরাপত্তার জন্য রাজধানীর শপিংমল ও আবাসিক এলাকার বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীদের নিয়োগ দেয়ার কথা জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, তাদের হাতে একটি ব্যান্ড থাকবে যে সহায়ক পুলিশ কর্মকর্তা। আইন মোতাবেক উনি আমি বা আমার পুলিশ অফিসার যে দায়িত্ব পালন করেন, সেই একইরূপ দায়িত্ব পালন করবেন। যেকোনো ব্যক্তিকে উনারা গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবেন এবং সাথে সাথে পুলিশ অফিসারকে আইনগতভাবে যে প্রোটেকশান দেয়া হয়েছে উনারা সেই প্রোটেকশানটা পাবেন। এ কার্যক্রমটি আমি শুরু করেছি। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, উনি যখন পুলিশ কমিশনার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, তিনি সিম্পলি পুলিশ অফিসার। পুলিশ অফিসার যে দায়িত্ব পালন করে, উনি একই দায়িত্ব পালন করবে। উনি যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা বা সক্ষমতা প্রাপ্ত হবেন। একটা বসুন্ধরা শপিংমল, এখানে হয়তো ৫০ জন আছে। উনাদেরতো একজন নেতা আছে। আমরা উনাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে দেব।
তারাবির সময় মুসল্লিরা দেড়-দুই ঘণ্টার জন্য নামাজে যান জানিয়ে তিনি বলেন, ওই সময় বিভিন্ন রাস্তাঘাটে জনশূন্যতা দেখা যায়। এ সময় আপনাদের বাড়ি, ফ্ল্যাট, দোকান একটু সযত্নে রেখে আসবেন, নিরাপত্তা খেয়াল করবেন। ঈদের সময় রাজধানীর নিরাপত্তায় পুলিশের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হলেও ঢাকাবাসীকে গ্রামে যাওয়ার সময় নিজেদের বাসা-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ‘নিজ দায়িত্বে’ নিশ্চিত করে যেতে অনুরোধ করেছেন তিনি।
সাজ্জাত আলী বলেন, আশা করছি ১৫ রোজার পরেই ঢাকাবাসী অনেকেই গ্রামে তাদের নিকটজনের সাথে ঈদ উদযাপনের জন্য চলে যাবে। আমি পুলিশ কমিশনার হিসেবে ডিএমপির পক্ষ থেকে আপনাদেরকে জানাতে চাই, অনুরোধ করতে চাই, দয়া করে যখন আপনি বাড়ি যাবেন তখন দয়া করে আপনার বাড়ি, ফ্ল্যাট, দোকান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, এটির নিরাপত্তাব্যবস্থা নিজ দায়িত্বে করে যাবেন।
ঢাকায় ‘বড় অপরাধের’ সংখ্যা খুবই কম মন্তব্য করে ডিএমপি কমিশনার বলেন, আপনারা যদি বিগত বছরের পরিসংখ্যান দেখেন, অথবা অন্য দেশের বড় বড় শহরের অপরাধচিত্রের সাথে একটি তুলনামূলক চিত্র দেখেন, সেই চিত্রে ঢাকা শহরে অপরাধের সংখ্যা কমই দেখতে পাবেন।
বর্তমানে অপরাধের বেশিরভাগই ‘স্ট্রিট ক্রাইম’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ইদানিং কিছু স্ট্রিট অপরাধ হয় আপনারা জানেন। ৮০-৯০ ভাগ ক্ষেত্রে সেটি মোবাইল নিয়ে টান দেয় উঠতি বয়সের ছেলেরা। আমরা যাদের কিশোর গ্যাং বলি তারা। বাসের, প্রাইভেটকার, মোটরবাইকের যাত্রী হয়তো কথায় মনোনিবেশ করেন, তখন পেছন থেকে এসে মোবাইলটা টান দিয়ে দৌড় মারে। এমন কিছু স্ট্রিট ক্রাইম হয়। ঢাকাবাসীকে আশ্বাস দিতে চাই, এরূপ একটি বড় শহরে নানা পেশার, নানা গোষ্ঠী এবং প্রচুর ভাসমান লোক। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিনিয়ত লাখ লোক আসে, কয়েক লাখ লোক চলে যায়। এরূপ একটি শহরে কিছু একটি ঘটনা ঘটলে আপনারা অবশ্যই আতঙ্কিত হবেন না। ডিএমপি আপনাদের পাশে আছে। আমরা কাজ করে যাচ্ছি, ঘটনা ঘটলে আমরা সেটি উদ্ঘাটনের জন্য চেষ্টা করি।
ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৯ মাসে ঢাকার বিভিন্ন থানায় খুনের মামলা হয়েছে ৪০২টি, এর মধ্যে সেপ্টেম্বরেই হয়েছে সর্বোচ্চ ১৪৮টি। এছাড়া অগাস্টে ১১৯টি, জুলাইয়ে ৫৯টি, জুনে ১৩, মে মাসে ১৬, এপ্রিলে ১৪, মার্চে ১৮, ফেব্রুয়ারিতে ৪ আর জানুয়ারিতে হত্যা মামলা হয়েছে ১১টি। এছাড়া গত ৯ মাসে দস্যুতার ১৬২টি, ডাকাতির ২৪টি, অপহরণের ৭২টি এবং চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪৬১টি। এর মধ্যে অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে দস্যুতার মামলা ১৮টি, ডাকাতি ৯টি, অপহরণের ৩৩টি এবং চুরির মামলা হয়েছে ৪৮টি। তবে পুলিশি ঝামেলা এড়াতে চুরি-ছিনতাইয়ের মতো ঘটনায় পুলিশের কাছে যান না অনেকেই। এ কারণে অপরাধের সঠিক চিত্র মামলার এই পরিসংখ্যানে উঠে আসে না।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বনশ্রীতে ব্যবসায়ীকে গুলি করে টাকা ও সোনা লুটের ঘটনায় ৬ জনকে গ্রেপ্তারের তথ্য দিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ঘটনাটি বিভিন্ন মিডিয়ায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার হলে মানুষের মধ্যে ব্যাপক নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে। সেজন্য আমি ঘটনাটি উদ্ঘাটনের জন্য ডিবিকে সর্বাত্মক চেষ্টা করে ডিটেকশানের দায়িত্ব দেই। নিবিড়ভাবে কাজ করার পরে আমরা এ ঘটনাটি উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছি। এ ঘটনায় ৭ জন জড়িত ছিল, তারমধ্যে আমরা ৬ জনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই। ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্রটিও আমরা উদ্ধার করি ২ রাউন্ড গুলিসহ। সাথে স্বর্ণ, বিক্রিত স্বর্ণের ২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা এবং যে দুটি মোটরসাইকেল ব্যবহৃত হয়, তারমধ্যে একটি আমরা উদ্ধার করি।
সাজ্জাত আলী বলেন, যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের মধ্যে লিডার ছিল কাউসার। তারপর খলিল ও ফরহাদ। ব্যাকআপ ও রেকি পার্টিতে দায়িত্বরত ছিল সুমন, দুলাল চৌধুরী ও আমিনুল। এটি উদ্ঘাটন করতে গিয়ে আমরা আরও অন্যান্য ডাকাত দল চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছি এবং অচিরেই তাদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হব। এ সময় তিনি মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন কোনো ঘটনা বার বার প্রচার না করার অনুরোধ জানান, যেগুলো জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।